মো. মুরাদ হোসেন
পাহাড়ি নৈসর্গিক সবুজায়নে আবৃত আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ ও অন্যতম স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের রাণী খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে ১০টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ৮৭২ জন শিক্ষক, ২৭ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থী, ১২টি আবাসিক হল ও যাতায়াতের বাহন হিসেবে দু’জোড়া শাটল ট্রেন নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এতসব ব্যবস্থাপনার মধ্যেও স্বস্তিতে নেই চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অব্যস্থাপনা, রাজনৈতিক সহিংসতা, স্থানীয়দের আধিপত্য, বেহাল শাটল ট্রেন ব্যবস্থা, আবাসন সংকট, রুটিন মাফিক মানসম্মত ক্লাস না হওয়া ইত্যাদির কারণে চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হতাশায় ও ক্ষোভে দিনাতিপাত করছে। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে চবিতে ভর্তি হবার কিছুদিনের মধ্যেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মুখে হতাশার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। বরং প্রতিনিয়ত সমস্যাগুলোর সংকট বেড়েই চলেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন হিসেবে দু’জোড়া শাটল ট্রেন প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে চলাচল করে। চবির প্রায় ৭০% শিক্ষার্থী টিউশনির প্রয়োজনে ও আবাসিক সিট সংকটের ফলে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করে। বগি সংকট, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ, বহিরাগতদের উৎপাত, চুরি-ছিনতাই, শাটলে বসে মাদক গ্রহণের কারণে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে চবির শিক্ষার্থীদের প্রাণের শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীর তুলনায় শাটল ট্রেনের বগি কম হওয়ায় ও ট্রেনের লাইট-ফ্যান এর সুবিধা না থাকায় বগির ভিতরে অসহনীয় তাপমাত্রা ভিতরে গাদাগাদি যাওয়া আসা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শাটল ট্রেন ব্যবস্থা রাখা হলেও বহিরাগত ও স্থানীয় লোকদের উপচে পড়া ভিড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী নিজেদের শাটল ট্রেনে জায়গা পায়না। বহিরাগত যাত্রীদের দ্বারা প্রায় নারী শিক্ষার্থীরা শাটল ট্রেনে যৌন হয়রানির মত ন্যাক্কারজনক ঘটনার শিকার হন।
সর্বশেষ ১৪ এপ্রিল রাতে চবির তৃতীয় বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শাটল ট্রেন চলাচলের সময় পাথর নিক্ষেপ করে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। গত একমাসে প্রায় ১৭ জন শিক্ষার্থী পাথরের আঘাতে আহত হয়েছে। প্রতিনিয়ত পাথরের আঘাতে আহত হচ্ছে চবির শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে যাওয়ার পূর্বে অনিরাপত্তায় ভোগে ক্যাম্পাসে যাবে কি যাবে না। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হলেও শাটল ট্রেনের গতি বৃদ্ধি হয়নি। একমুখী রেললাইন ও অপ্রয়োজনীয় স্টপেজ কারণে গতি বৃদ্ধি করা যায়নি শাটল ট্রেনের। যার ফলে প্রতিদিন শাটল কেন্দ্রীক শিক্ষার্থীদের প্রায় তিন ঘণ্টার উপরে সময় নষ্ট হয়। গাদাগাদি করে দীর্ঘ সময় ধরে যাওয়া আসা করতে গিয়ে প্রায় শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চবি ক্যাম্পাসে আরেকটি বড় সমস্যা হলো স্থানীয় কিছু অসাধু প্রভাবশালীদের আধিপত্য। শিক্ষার্থীদের উপর একের পর এক হামলার ঘটনা চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় এই প্রভাবশালী দুর্বৃত্তরা। গত একসপ্তাহে তিনবার শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ২০ শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেছে স্থানীয় এই গ্যাং ও সিএনজি চালকেরা। এদের হাতে সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হন নারী শিক্ষার্থীরা। এই স্থানীয়দের হাতে ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ১নং রেল ক্রসিং এলাকায় খুন হন ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান আসাদ। স্থানীয়দের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের দুটি মাধ্যমই এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সিএনজি- রিকশা চালকদের অসদাচরণ ও বেশি ভাড়া দাবির কারণে প্রায় শিক্ষার্থীদের সাথে চালকদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলগেটে এক সিএনজি চালকের সাথে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। পরে এই বাকবিতণ্ডার জেরে ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করে স্থানীয়রা। এই ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে প্রতিবাদরত ১২ শিক্ষার্থীকে মারধর করে স্থানীয়রা। এর আগে গত ১১ এপ্রিল এক অটোরিকশা চালকের হাতে হেনস্তার শিকার হন এক নারী শিক্ষার্থী। স্থানীয় গাড়িচালকদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিজস্ব চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর দাবি শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু ছিল। কিন্তু বাজেট স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে প্রশাসন তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে চবির শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মিলনকেন্দ্রের জন্য টিএসসি নির্মাণ, যথাসময়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা, এনালগ পদ্ধতি পরিহার করে সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা এবং সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার দাবি চবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ দিনের দাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনাকে চলমান সকল সংকটময় পরিস্থিতির জন্য অন্যতম দায়ী বলে মনে করেন এবং শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে বারবার প্রশ্নও তুলছেন। যেকোনো সমস্যার সঠিক তদন্তে ব্যর্থতা, দোষীদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কালক্ষেপণ করার ফলে সমস্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সংবাদমাধ্যমকেও বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করতে দ্বিধাবোধ করছে না স্থানীয় প্রভাবশালী ও সিএনজি-ট্যাক্সি চালকেরা। গত কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কর্মদক্ষতাই পারে চলমান সংকট নিরসনের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আমানত ও মৌলিক দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতির মেধাবী সন্তান ও আগামীর দেশগড়ার বুদ্ধিদৃপ্ত কারিগর। তাদের নিরাপদে জ্ঞান অর্জন নিশ্চিত করতে না পারলে আগামীর বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সরকারেরও এই বিষয়গুলোতে সুনজর রেখে সমাধান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মো. মুরাদ হোসেন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post