সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক
করোনা মহামারির কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার ১৩ দিনের মাথায় মাউশি অধিদপ্তরের নেতৃত্বে আমাদের শিক্ষকরা টিভি ক্লাস শুরু করে দিলেন।
এরই সূত্র ধরে সারা দেশে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে যায়। সেক্ষেত্রেও বেশির ভাগ শিক্ষক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একেবারে নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত করার আচমকা ধাক্কাটা সামলে দ্রুত ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। একইসঙ্গে প্রায় সব জেলা ও উপজেলায় অনলাইন স্কুল শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু এত কিছুর পরও সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। কারণ সবার টিভি নেই বা থাকলেও সেখানে সংসদ টিভি দেখা যায় না, কারও কারও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ নেই বা থাকলেও মোবাইল ডেটা কেনার টাকা থাকে না, বা সবকিছুর পরও ডিভাইস না থাকায় অনেকে এসব ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছিল না।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। ডিসিদের সঙ্গে কথা বললাম, ডিশ ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বললাম, শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও অভিভাবকদের পরামর্শ নিলাম। তাতে কিছুটা কাজ হলো। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু এলাকায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারলাম না।
সারা দেশ থেকে শিক্ষকরা আমাকে বলছিলেন, শুরুতে যাও বা ছিল ধীরে ধীরে অনলাইন ক্লাসের শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। আমার মনে আছে, আমি মোটামুটি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ডিজিটাল ডিভাইডের যে আশঙ্কা বিশ্বব্যাপী করা হচ্ছিল, তা যে আমাদের দেশেও সত্যি হয়ে যাবে, আমি প্রায় দিব্য চোখে তা দেখতে পাচ্ছিলাম।
অবকাঠামোগত সুবিধা থাকার কারণে একাংশের লেখাপড়া-পরীক্ষা সবই চলবে; কিন্তু একইসঙ্গে অবকাঠামোগত অসুবিধা থাকায় অন্য বহু শিক্ষার্থী অনেক পিছিয়ে পড়বে। অর্থাৎ আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার যে লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করার কথা, তা তো অর্জিত হবেই না বরং আগের অগ্রগতিটাও আর ধরে রাখা যাবে না।
কী করা যায়? মাথায় কিছু আসছিল না। যেহেতু মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা আমাকে সবসময় ভালো পরামর্শ দিতেন, তাই ঠিক করলাম এ মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আবার ওদের কাছেই যেতে হবে। ওদের সঙ্গে একের পর এক মিটিং শুরু করলাম। কখনো বিভাগীয় পর্যায়ে, কখনো জেলা পর্যায়ে, কখনো স্কুল কিংবা কখনো কলেজ পর্যায়ে প্রায় দিন-রাত জুম সভা করতে থাকলাম।
এখানে অবশ্য জুম অ্যাপকে একটি ধন্যবাদ না দিলেই নয়। জুম থাকায় যতজন এবং যত ধরনের অংশীজনের সঙ্গে আমরা কথা বলতে পেরেছি, জুম না থাকলে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হতো কিনা সন্দেহ। আমার মনে আছে, একদিন যখন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সঙ্গে কথা বলছি, তখন তাদের মধ্যে কেউ একজন হঠাৎ পরীক্ষার কথা বলতে গিয়ে ‘ওপেন বুক এগজাম’ কথাটা উচ্চারণ করলেন। কথাটা আমার মাথায় গেঁথে গেল।
এরপর যে বিভাগ বা যে জেলার সঙ্গে আলোচনা করেছি, এ প্রসঙ্গটি টেনে এনেছি। বিচিত্র সব অংশীজনদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করতে করতে বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যেভাবে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতাম, স্কুল-কলেজে ঠিক সেরকম না হলেও অন্য কোনোভাবে এটা চালু করা সম্ভব। এবং এতে যেটা হবে সেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অসুবিধা আর কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
আমরা মাউশির পক্ষ থেকে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতির অপেক্ষা। তবে তাতে কোনো বেগ পেতে হলো না। একটা মিটিংয়ে অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তাব ওঠানো মাত্র মাননীয় মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এতে অ্যাসাইনমেন্টের যাত্রা যে নিষ্কণ্টক হয়ে গেল তা নয়। অ্যাসাইনমেন্টের ঘোষণা আসামাত্র নানা দিক থেকে আক্রমণ আশা শুরু হলো। বলা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যা করে, তা স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মানে এক অর্থে তাদের সর্বনাশ করা।
বলা হলো, স্কুলের শিক্ষকরাই তো জানেন না অ্যাসাইনমেন্ট কী জিনিস, শিক্ষার্থীরা তো কোন ছাড়। বলা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেখানে প্লেজিয়ারিজমের কারণে অভিযুক্ত হন, সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা তো নকল করবেই; তাহলে কেন তাদের এ অনৈতিক কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া? বলা হলো, অ্যাসাইনমেন্ট চালু করতে হলে স্কুলে স্কুলে প্লেজিয়ারিজম চেক করার সফটওয়্যার সরবরাহ করতে হবে। এরকম আরও নানা ধরনের আক্রমণ ও পরামর্শ আসা শুরু হলো।
একটা বড় সমালোচনা ছিল, শিক্ষার্থীরা নকল করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে। ইউটিউবে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে; কেউ কেউ, এমনকি কোনো কোনো শিক্ষকও অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে তা শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও সেটা কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করে তাদের সন্তানদের সর্বনাশ করছেন। আর শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মূল সমালোচনাটা হলো, শিক্ষার্থীরা যা-তা লিখে কিছু একটা জমা দিলেই সেটা ভালোভাবে না দেখে তারা একটা মনগড়া নম্বর দিয়ে দিচ্ছেন। খবর নিয়ে দেখলাম, কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়।
আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, অ্যাসাইনমেন্টে নিজেদের মতামত লেখাটাই যথেষ্ট। অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করার সময় এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য রেখেছিলেন যেন শিক্ষার্থীরা নিজেরা পড়ে-বুঝে, নিজের মতামত দিয়ে লিখতে পারে; এবং এভাবে অন্যদের সাহায্য ছাড়া তাদের যেন নিজে নিজে শেখার ক্ষমতা তৈরি হয়।
শিক্ষকদের জন্য আমরা তিনটি পদক্ষেপ নিলাম। প্রথমত, শত শত মিটিং করে তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম; দ্বিতীয়ত, এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা তাদের জন্য মূল্যায়ন ছক তৈরি করে দিলেন; এবং তৃতীয়ত, আমরা ঘোষণা করলাম, শিক্ষার্থীরা নকল করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে কিনা, কিংবা শিক্ষকরা হেলাফেলা করে মূল্যায়ন করছেন কি না, তা বোঝার জন্য শিক্ষা বোর্ডগুলো কিছু অ্যাসাইনমেন্ট দ্বিতীয়বার মূল্যায়ন করবে।
সেখানে ত্রুটি পাওয়া গেলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও সারা দেশে আমাদের সফর শুরু হলো। আমি নিজে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের নিয়ে টিম তৈরি করে স্কুলে স্কুলে সশরীরে অ্যাসাইনমেন্ট দেখা শুরু করলাম। সেসব আবার টেলিভিশনগুলো ফলাও করে প্রচার করল। এতে শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী নন, অভিভাবকরাও সতর্ক হয়ে গেলেন।
সত্যি সত্যি শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের আন্তরিক চেষ্টায় অ্যাসাইনমেন্টের পক্ষে একটা জনমত তৈরি হয়ে গেল। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের দেওয়া তথ্য নয়, মিডিয়াও আমাদের বুঝিয়ে দিল-করোনাকালে অ্যাসাইনমেন্টই শিখন-শেখানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। রেডিও, টিভি, ইউটিউব ও ফেসবুকে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে মজার মজার অনুষ্ঠান, গান ও নানা ধরনের পোস্টে যখন লাখ লাখ ভিউয়ার লাইক দিচ্ছিল, তখন বোঝা গেল অ্যাসাইনমেন্টের মতো একটা একাডেমিক বিষয়ও টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হতে পারে। টিভি ক্লাস এবং অনলাইন ক্লাস দিয়ে আমরা যেসব জায়গায় পৌঁছতে পারিনি, অ্যাসাইনমেন্ট সেসব জায়গায় পৌঁছে গেল। শতকরা চুরানব্বই ভাগ শিক্ষার্থী এ কার্যক্রমে অংশ নিল।
অ্যাসাইনমেন্টের কার্যকারিতা নিয়ে পরে যে গবেষণাটি হয়, তাতে দেখা যায় শুরুতে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছিল, শেষের দিকে এসে তার বেশির ভাগই দূর হয়ে যায় এবং অ্যাসাইনমেন্ট একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসাবে পরিণত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, অ্যাসাইনমেন্ট দেশের শিক্ষায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, যেমন শিক্ষার্থীরা স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও তাদের দায়িত্ব পালনে সচেতন হয়ে ওঠেন। এ দুটি বিষয়ই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে তথা এসডিজি-৪ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক; অধ্যাপক ও ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ
Discussion about this post