অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা দশটিসহ মোট ১২টি বাজেট দিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করে গেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি একজন সফল, উচ্চাভিলাষী, স্বপ্নবাজ ও রেকর্ডধারী অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ- এমন নানা পরিচয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেখে গেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক। ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন এই আলোকিত গুণীজন একজন ন্যায়নিষ্ঠ, সজ্জন চিৎপ্রকর্ষ বিদ। সরলতা, সততা ও সত্য কথনে তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।
শুক্রবার (২৯ এপ্রির) দিবাগত রাতে ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আবুল মাল আবদুল মুহিত মহকুমা হাকিম (এসডিও) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি প্রশাসন ও কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন শেষে অর্থমন্ত্রী হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেন।
এএমএ মুহিত ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৬ সালে লাহোরস্থ সিভিল সার্ভিস একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। মহকুমা হাকিম (এসডিও) হিসেবে তার প্রথম কর্মস্থল ছিল মুলতান। পরবর্তীতে তিনি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাছাড়াও ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০-১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে মুহিত সরকার কর্তৃক তমগা-এ-খেদমত খেতাবে ভূষিত হন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কমিশন প্রধান ও ডেপুটি সেক্রেটারি থাকাকালে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রদান করেন। প্রতিবেদনটি পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত পূর্ব ও পশ্চিম বৈষম্য প্রসঙ্গে প্রথম প্রতিবেদন।
১৯৬৯ সালে এএমএ মুহিত যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর পদে যোগ দেন। তখন গড়ে উঠে ১৯৬৯ সনের গণ অভ্যুত্থান। ১৯৭০ এর নির্বাচন ও পাকিস্তানিদের বৈরিতা তাকে ব্যথিত করে তোলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনিই প্রথম কূটনৈতিক যিনি বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের কূটনৈতিক দায়িত্ব ত্যাগ করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হলে তাকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ১৯৮১ সালে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইডিবি ও জাতিসংঘ সংস্থাসমূহে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ করে নন্দিত হন।
মুহিত ১৯৮২-১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪-১৯৮৫ সালে তিনি তৎকালীন সরকার থেকে অবসর নিয়ে আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো হিসেবে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজ এলাকা সিলেটকে ‘আলোকিত সিলেট’ হিসেবে রূপায়ণের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
এরপর এএমএ মুহিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে অংশ নেন। তাতে জয়লাভ করতে না পরলেও তিনি ‘আলোকিত সিলেট’ গড়ার লক্ষ্যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নে নিজেকে একজন নিরলস কর্মীতে রূপান্তরিত করেন।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি সিলেট-১ সংসদীয় আসনের এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিগত ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। এরমধ্যে তিনি টানা ১০টি বাজেট উপস্থাপনের রেকর্ডও গড়েছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় সংসদের ৪৮তম, নিজের ১২তম ও শেষ বাজেট উপস্থাপন করেন মুহিত। স্বাধীন বাংলাদেশে টানা ১০ বার বাজেট পেশ এর আগে কোনো অর্থমন্ত্রীর করার সুযোগ হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৩৯তম বাজেট পেশ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় সংসদের ৪৮তম, নিজের ১২তম ও শেষ বাজেট উপস্থাপন করেন মুহিত। এর আগে মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ দুই অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন।
১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন তিনি। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। দুইজনই রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ব্রিটিশ ভারতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মুহিতের এক মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় মেয়ে সামিয়া মুহিত আন্তর্জাতিক ব্যাংকার, বড় ছেলে শাহেদ মুহিত স্থপতি এবং ছোট ছেলে বিদেশে শিক্ষকতায় নিয়োজিত। মুহিতের সহধর্মিণী সৈয়দা সাবিহা মুহিত একজন ডিজাইনার।
সংস্কৃতিমনা পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু-কিশোর সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়। আটাশি বছর বয়সেও তার সৃজনশীল চর্চা থেমে থাকেনি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে স্কুল ছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন। চাকরিরত অবস্থায় মুহিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
এএমএ মুহিত অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছে।
Discussion about this post