সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী তবে তার অভ্যস্ত রূপ দেখতে শুরু করলো আবার? গত মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বিরোধী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা যেন সেকথাই মনে করিয়ে দিল। প্রথমদিন, ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের কর্মসূচি ছিল ছাত্রদলের। কিন্তু তাদের সেটা করতে দেয়নি ছাত্রলীগ। দু’পক্ষই লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক, লোহার পাইপ ও ইট পাটকেল নিয়ে একে অন্যের ওপর আক্রমণ চালায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক নারীকেও পেটানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ঘোষণা দিয়ে এসেও ঢুকতে পারেনি ছাত্রদল।
একটা জেদাজেদি লক্ষ করা যাচ্ছে। ছাত্রদল যে করেই হোক ক্যাম্পাসে যাবে, সমাবেশ করবে, মিছিল করবে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ যে করেই হোক তা প্রতিহত করবে। ছাত্ররাজনীতির অধিকার থাকলে, সব সংগঠনেরই ক্যাম্পাসে মিছিল মিটিং করার অধিকার আছে এবং সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সংগঠনের শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের অধিকার রয়েছে। সেটা ছাত্রলীগ কেন মানছে না সেটার নানা রকম ব্যাখ্যা ও কারণ তাদের দিক থেকে আসছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমরা সেখানে তাদের ভূমিকা দেখতে পাইনি।
পড়ুয়ারা কেবল মুখ গুঁজে লেখাপড়া করবে, সমাজ ও পরিপার্শ্ব নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সোচ্চার ও সক্রিয় হবে না, এমনটা ভাবা অবাস্তব ও অবাঞ্ছনীয়। তারা শুধু ক্যারিয়ারের কারাগারে বন্দি থাকবে, এই ভাবনাটা ভুল। দুঃসহ দুর্বার বয়সে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে প্রথম স্বাধীন সম্পর্ক ও আদানপ্রদানের বয়সে সমাজ নিয়ে ভাবনাটা শুরু করতেই হবে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পর থেকে গত তিন দশকে যা হচ্ছে, সেটা এই ভাবনার সাথে যায় না। সমাজের সঙ্গে নিজের সত্তার বোঝাপড়ার ভিত গড়তে কোনভাবেই সহায়তা করছে না এই রাজনীতি।
ছেলেমেয়েরা যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শাসন ব্যবস্থাকে, প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ করার চেতনা লাভ করতে পারত, সেটা এই সহিংস, আধিপত্যবাদী ও চাঁদাবাজি ধরনের ছাত্ররাজনীতির কারণে সম্ভব হচ্ছে না। ছেলেমেয়েদের হাতিয়ার করে শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গু করে রেখেছে এই রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতি যেমন সহিংস, সত্যি বলতে কোন কোন ক্ষেত্রে অসভ্য, তেমনি শিক্ষকদের রাজনীতিও কদর্য। তারা এখন সরাসরি দল করেন এবং দলের মোহে প্রকৃত শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকতেই আনন্দিত হন বেশি।
উপরে বর্ণিত এই শিক্ষা-রাজনীতি নিয়ে বিশেষ ভাবনা নেই আমাদের। এখন দেশ জুড়েই উচ্চ শিক্ষাপ্রাঙ্গণে বিশৃঙ্খলা, হিংসা, মৃত্যু এবং উপাচার্যদের দুর্নীতি ও নানা কীতি। শিক্ষা-রাজনীতির সংযত ও গঠনমূলক দিক কোথাও পাওয়া যায় না।
অনেক ছাত্রই আমাকে বলে ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে হলে পড়ালেখার পরিবেশ নেই। আমাদের সময় টানা নয় বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, মিটিং-মিছিল হয়েছে, পুলিশি হামলা হয়েছে, হল তল্লাশি হয়েছে। কিন্তু পঠনপাঠন যাচ্ছেতাইভাবে বিঘ্নিত হয়েছে একথা কেউ বলবে না। এখন যে ক্যাম্পাস রাজনীতি হয় তাতে নেই সচেতন মননসমৃদ্ধ সমাজচর্চার কোন সুযোগ। এই চিন্তাবর্জিত রেষারেষি হানাহানির কবলে পড়ে যে নেতৃত্ব উৎপাদিত হচ্ছে এই ছাত্র রাজনীতি থেকে তারা দীর্ঘ মেয়াদে সমাজের শত্রু ও বিনষ্টকারী কিনা সেটা ভাববার লোকও নেই এখন।
দুই.
বিপক্ষীয় ছাত্র-সংগঠনের পাল্লা দিয়ে উৎকট হানাহানিতে ছাত্র ও যুবসমাজের কী মূল্যবোধ বিকশিত হচ্ছে? এই রাজনীতি একটা বড় দক্ষতা শিখিয়ে দিচ্ছে ছাত্রনেতা ও নেত্রীদের আর সেটা হলো নষ্টামি পাকিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলা। এটাই নাকি স্মার্টনেস। যদি তাই হয় তাহলে এদের দ্বারা সমাজের কোন উপকারটা সাধিত হবে শুনি?
ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির দলায়ত্ত বিকার নিয়ে চিন্তিত নয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বরং একটা সংস্কৃতি হলো প্রায় সব দলের নেতা-কর্মীরাই তাদের ছাত্র সংগঠনের সহিংসতা, অ-রাজনৈতিক রাজনীতি ও অগণতান্ত্রিক বিকাশ- কে প্রকাশ্যে বা গোপনে সাধুবাদ জানায়। কিছু না পারলে অস্বীকার করে। এই প্রশ্রয় যে দিনশেষে দুর্বৃত্তায়নের সার্টিফিকেট হয়ে দাঁড়ায় সেটা তারা বুঝতে চান না।
নিজেদের ইচ্ছাবিলাস চরিতার্থ করার জন্য চরম ও প্রকট ভাবে আদর্শহীন লম্পট একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে দিয়ে। এতে করে ছাত্র ও যুবসমাজের সামাজিক বোধ ও কর্মোদ্যমী করার ঠিক রাস্তা বের করা যাচ্ছে না। যে চোরা গলিতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কে দেখাবে?
Discussion about this post