শিক্ষার আলো ডেস্ক
মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাই করার লক্ষ্যে সরকার সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে। ২০০৮ সালে যখন এটি চালু করা হয়, তখন বলা হয়েছিল এই পদ্ধতিতে নোট ও গাইড বই থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ফল হয়েছে উলটো। শিক্ষকেরাও বিষয়টি ভালোভাবে না বোঝায় শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট বা সহায়ক বইয়ের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে আগের চেয়ে আরো বেশি। নোট-গাইড পড়ে না কিংবা প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিংয়ে যায় না এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন হাতেগোনা।
২০০৮ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু হয় এই পদ্ধতি। এর আগের বছর ২০০৭ সালের ১৮ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই পদ্ধতি চালুর ১৩ বছর পরও যে এই শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আয়ত্ত করতে পারেনি, তার নানা প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্নভাবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা এখনো এই শিক্ষার ভীতির কথা বলছেন। এছাড়া সরকারের সর্বশেষ সমীক্ষায়ও এই শিক্ষায় শিক্ষকদের দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
অভিভাবকেরা বলছেন, এই পদ্ধতির প্রশিক্ষণ তো আমরা পাইনি যে ঘরে বসে নিজেরা পড়াতে পারব। তাই সন্তানের জানার জন্য, পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কোচিংয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, এই পদ্ধতিতে ভীতি আছে, কিন্তু এই ভীতি বাধ্য হয়ে সহ্য করে নিয়েছি এবং নিচ্ছি।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে মাধ্যমিকে বাংলা ও ধর্ম শিক্ষায় ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’তে প্রথম পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। চালুর পর বিভিন্ন মহল থেকে এই পদ্ধতি বাতিলের দাবি ওঠে। কিন্তু কোনো দাবিই মানা হয়নি। এমনকি শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই চালু করা হয় এই পদ্ধতি। তবে এই পদ্ধতি চালুর বেশ কয়েক বছর পর থেকে শিক্ষকেরা সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন কি না, সমীক্ষা করে আসছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। কিন্তু কোনো সমীক্ষায়ই আশা জাগায়নি। শিক্ষকেরাও যে এই পদ্ধতিতে ভীত, এই পদ্ধতি বোঝেন না, তার চিত্র উঠে আসে সমীক্ষায়। দেখা গেছে, শিক্ষকদের বড় একটি অংশ এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না।
গত ডিসেম্বরে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ৫৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। আর ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন না। এমনকি সৃজনশীল পদ্ধতিতে বরিশাল বিভাগের ৬৪ শতাংশ শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না।
যারা পারেন না, তারা অন্য স্কুলের সহায়তায় প্রশ্ন তৈরি করেন। আর কিছু শিক্ষক বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে আনেন। অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, এর হার ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে এরূপ বিদ্যালয়ের হার ২৩ শতাংশের সামান্য বেশি। শিক্ষা অধিদপ্তর সারা দেশের ৯টি অঞ্চল থেকে ৪ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে।
সমীক্ষার পরিচালনায় জড়িত শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যালয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নিজেরাই যাতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষক নিজে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করলেই কেবল সৃজনশীল পদ্ধতির মূল লক্ষ্য সাধিত হবে। সুতরাং, বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে চিন্তন দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন—জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, মাস্টার ট্রেইনাররা এসএসসি ও এইচএসসির প্রশ্ন করেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যাগুলো হয় স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়। এই শিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আরো বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
Discussion about this post