ইসরাত জাহান নিঝুম
বর্তমানে আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদের সমাজে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আত্মহত্যা কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান না হলেও সারা বিশ্বে এর প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছে। বাংলাদেশে এই হার ১১ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার। আমাদের দেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ আত্মহত্যার মধ্যে নিজেদের মুক্তি কিংবা সমস্যার সমাধান খুঁজছে, যা সম্পূর্ণ ভুল। ধর্মীয় দিক দিয়ে যেমন আত্মহত্যা মহাপাপ, ঠিক তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক বিবেচনা করলেও আত্মহত্যার কারণে আমাদের দেশ ও জাতি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিগত কয়েক মাসে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশ লক্ষণীয়। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হতাশা, মানসিক চাপ, প্রতারণার শিকার, পারিবারিক কলহ, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হওয়া, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, একাকিত্ব, অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি থেকেই মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। তবে ব্যক্তি এবং পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে আত্মহত্যার কারণও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আত্মহত্যাই সমাধান— এমন একটি ভুল ধারণা মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের মনে স্থান করে নেওয়ায় খুব সহজেই তারা আত্মহত্যায় উৎসাহিত হচ্ছে। সাময়িকভাবে সব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যাকারী এ পথ বেছে নেওয়ার ফলে তার পরিবার-পরিজন নানাবিধ সমস্যা ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়।
একজন মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষেরই তার পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে। প্রতিটি মানুষের উচিত, নিজ নিজ জায়গা থেকে তার দায়িত্ব পালন করার মানসিকতা রাখা এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবকিছু নিয়ে ভাবা। যে কোনো সমস্যার কার্যকরী সমাধান খোঁজা। যেহেতু সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষকে বেঁচে থাকার সুবিধা দিয়ে থাকে, তাই তার থেকে ভালো কিছু পাবে— এমন প্রত্যাশাও করতে পারে সমাজ এবং এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই, যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়ে একমাত্র নিজের কথা ভেবে সবার প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে অযৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া পরিবার, সমাজ ও দেশের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
জীবনে কোনো সমস্যা আসবে না— এমন চিন্তা করা এক ধরনের বোকামি। জীবনে সমস্যা আসবেই এবং তা সমাধানের পথ বাতলেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে— এটাই নিয়ম, এটাই জীবনের বিচিত্রতা। কিন্তু আত্মহত্যা একটি অযৌক্তিক, অপ্রত্যাশিত এবং অমীমাংসিত সমাধান। নিজেকে শেষ করার মধ্যে কোনো সমাধান নেই। আমাদের সামনে একটি সমস্যা এলে, জীবনের প্রতি বিমুখতার কোনো কারণ উদ্ভূত হলেও নিজেকে ভালোবাসার হাজারটা কারণ রয়েছে। একটি সুযোগ হাতছাড়া হলে সামনে অনেক সুযোগ আসবে। নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে, যৌক্তিকভাবে সব কিছু চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের জন্য খুবই নেতিবাচক। গবেষকরা বলছেন, মানসিক চাপই আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। প্রতিনিয়ত আমরা এমন অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছি, যারা মানসিক চাপে থাকে, অথচ আমরা তা বুঝতে পারি না বা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না— এ যন্ত্রণা থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে পারে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে আত্মহত্যা রোধে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে শক্ত করা যাবে, মনকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, যে কোনো সমস্যা বা অপ্রাপ্তিতে হতাশ না হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। জীবন থেকে পালিয়ে না গিয়ে জীবনের সকল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যে কোনো পরিস্থিতি থেকে সবকিছু নতুন করে শুরু করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post