এ. এন. রাশেদা
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো-ব্যানবেইসের ১৯৮৫ সালের প্রকাশনায় দেখা গেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ২১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৫ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ২০ দশমিক ১ শতাংশ। একইভাবে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ৩১৮ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে শিক্ষায় ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা মোট বাজেটের ২০ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৭৫ সালের পর এ খাতে বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। এখন আমাদের ৩০ শতাংশ বরাদ্দ প্রয়োজন। বস্তুত এই দাবির ভিত্তিতেই ১৯৮৪ সালে ‘বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’ গড়ে ওঠে। তাঁরাও ৩০ শতাংশ বরাদ্দের দাবি করেছেন এবং খুদা কমিশন রিপোর্ট ও ইউনেস্কোর সুপারিশেও তা উল্লেখ আছে।
শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প- সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষার বিকল্প নেই। এই বিশাল নেটওয়ার্ক সুষ্ঠু এবং বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য সব পর্যায়ে বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও কারিগর তৈরির জন্য প্রয়োজন বাজেটের ৩০ শতাংশ বা জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ বরাদ্দ। ইউনেস্কোর সুপারিশে শিক্ষকদের সেই মর্যাদা এবং কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে।
বাজেটের ৩০ শতাংশ বরাদ্দ হলে শিক্ষার সমস্যা অনেকাংশেই কাটবে। শিক্ষকস্বল্পতা কাটানোর লক্ষ্যে আমলাতান্ত্রিক বেড়াজাল ছিন্ন করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। ২০১৫ সালে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল; পরে স্থায়ীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে যাঁরা এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন, তাঁদের পূর্ণ বেতন স্কেলের মর্যাদা প্রদান করতে হবে। যাঁদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে ৫ থেকে এমনকি কাউকে ২০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় রাখা হয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পূর্ণ মর্যাদার বেতন স্কেল দেওয়া উচিত।
সারাদেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এলাকার শিশু-কিশোরদের এলাকার স্কুলে ভর্তি এবং শিক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে। শিক্ষকদের সম্মানজনক অবস্থান, ভালো বেতন-ভাতা, স্কুলে খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, উঁচুমানের শিক্ষার পরিবেশ আর এলাকার সুধীজনের সহযোগিতাই তৈরি করতে পারবে এলাকার শিশুদের এলাকার স্কুলে ভর্তির প্রতি আগ্রহ। এতে রাস্তার যানজট, পরিবেশ দূষণ, বাবা-মায়ের হয়রানি, পেট্রোল খরচ কমবে। এমন অনেক ইতিবাচক প্রাকৃতিক, সামাজিক, মানবিক দিক আছে শিক্ষাব্যবস্থার এই উন্নয়নের মধ্যে।
খেয়াল রাখতে হবে স্কুলের গভর্নিং বডিতে কাউকে দলীয় বিবেচনায় প্রবেশ করতে দেওয়া ঠিক হবে না। এখানে প্রাধান্য পাবেন প্রবীণ শিক্ষিতজন এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা, যাঁরা স্কুল তহবিলের টাকা তছরুপ করবেন না। শিক্ষাব্যবস্থা সরকারীকরণ না; শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ চাইতে হবে। এতে সরকার অর্থ দেবে, বেতন-ভাতাদি দেবে কিন্তু প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে না; হবে স্বায়ত্তশাসিত। প্রকৃত অর্থে একেই বলে জাতীয়করণ; সরকারীকরণ না। এতে শিক্ষা ক্যাডারদের সঙ্গে পদোন্নতি নিয়ে কখনোই সংঘাত হবে না। আর জাতীয়কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু আয়ের ২০ বা ২৫ শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থী-সংখ্যার সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। সব নিয়মে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকলে অপকর্মের সুযোগ থাকে না। শিক্ষকের পদোন্নতি হবে একই নিয়মে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চাকরিতে জ্যেষ্ঠদের দ্বন্দ্ব হবে না।
শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ১ :৩০ হলে কোচিং সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। কারণ ক্লাসেই পড়াশোনা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষক, কর্মচারী এবং এলাকার মননশীল, চিন্তাশীল ও দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতায় অধিকতর উন্নত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এটা সামাজিক উদ্যোগ। সব প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে না, কিন্তু সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে তার শিক্ষকমণ্ডলী এবং ছাত্রদের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় শিক্ষার পরিবেশ। এক সময় যেমন ছিল কারমাইকেল কলেজ, মুরারিচাঁদ কলেজ, ব্রজলাল কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, আজিজুল হক কলেজসহ অনেক কলেজ। আজ সরকারীকরণের ফলে অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়। শিক্ষক নেই, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, ল্যাবরেটরির সুযোগ-সুবিধা নেই, লাইব্রেরিতে বই নেই, ক্লাসে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী- এই অবস্থা ঢাকা শহরে অবস্থিত সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে প্রায় সর্বত্র। কাজেই সরকারীকরণ করেও শিক্ষা সমস্যার সমাধান হয়নি; হবে বলেও মনে হয় না।
শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় বাজেটের ৩০ শতাংশ ব্যয় নির্ধারণ করে, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে সর্বস্তরের পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে মেধাবী, সৎ, নির্লোভ, প্রকৃতিপ্রেমী, দেশপ্রেমী, মানবপ্রেমী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশিশক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে চান; শিক্ষকদের মধ্যে জানাশোনার পরিধি বাড়াতে চান; তাঁদের শিক্ষকবঞ্চনা ও শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বিষহ চিত্রগুলো জানতে হবে। বিষয়টি উল্লেখ করলেও সে লক্ষ্যে সামান্য একটু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ২০১৫ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির প্রয়োজনে সরকার মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিল। সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট-সেকায়েপ নামক বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে আকর্ষণীয় বেতনে সারাদেশের প্রায় ৩ হাজার স্কুলে ৫ হাজার ২০০ জন মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা মূলত গণিত, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান বিষয়ে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক (এসিটি) হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। এসব সুনাম অর্জনকারী শিক্ষকের চাকরি স্থায়ী করার সব লিখিত শর্ত পদদলিত করেও তাঁদের স্থায়ী করা হলো না। অথচ এ প্রকল্পের আওতায় ১৯ জন কর্মকর্তার ভ্রমণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২ কোটি টাকা, ২০১৬ সালের ১২ জুন দৈনিক সংবাদে যা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাপড়া জানা মানুষদেরই যখন এত ভোগান্তি, তখন দরিদ্র-নিরক্ষর মানুষের অবস্থা যে কী, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের দুর্নীতি এখনও কমেনি। এ ধরনের দুরাচার বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড এগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক অপিনিয়ন মোবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, যা তিনি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে বলেছিলেন :’আইনের চোখে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার। মজদুর কৃষকদের টাকা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা হয়। মজদুর কৃষকদের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সে অধিকার থাকবে। এর বেশি অধিকার তারা পেতে পারেন না। সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে, তাঁরা শাসক নন, সেবক।’
অথচ এ সময়ে আমরা আমলাদের দাপট দেখেছি। তাঁরা ইতোমধ্যে বেতন বাড়িয়ে নিয়েছেন। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতির সুবিধাও তাঁদের রয়েছে। অন্যদিকে, দফায় দফায় বেতন-ভাতার জন্য শিক্ষকদের রাস্তায় দিনের পর দিন অনশন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব ঘটনায় কি প্রমাণিত হয় না- কেন শিক্ষা খাতে বাজেটের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন?
এ. এন. রাশেদা: সাবেক অধ্যাপক, নটর ডেম কলেজ; সম্পাদক শিক্ষাবার্তা
Discussion about this post