সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা যদি নিজেরাই এমন অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকেন তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কী নৈতিকতার পাঠ নেবে? এমন প্রশ্ন উঠছে মানেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খারাপ শিক্ষা পাচ্ছে, শিক্ষকমণ্ডলী ভালো নয় এমন উপসংহারে আসা যাবে না।
সামগ্রিকভাবেই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতির পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কথা উঠছে সমান্তরালে।
দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮। এই বিপুল সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও আরও ১১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন জমা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। চলছে অনুমোদন পেতে দৌড়ঝাঁপ। বলা হচ্ছে, আবেদন জমা দেওয়া ব্যক্তি ও গ্রুপের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি অনুমোদন পাওয়ার আশায় এমন তদবিরে নেমেছেন যে তারা সফলও হয়ে যেতে পারেন।
পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কদর্য শিক্ষক আর ছাত্র রাজনীতিতে যখন অনিয়ম, দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে, তখন কোনও কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের মান, তাদের শিক্ষার্থীদের নানান ক্ষেত্রে সাফল্য সমাজে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত। করোনাকালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যতটা পেরেছে, তার চেয়ে বেশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব কারণে উচ্চশিক্ষা স্তরে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বলতেই হবে সবার চিত্রটা এমন নয়।
সংকটের একটি দিক হলো পড়ুয়া না পাওয়া। আসনের সিকিভাগ শিক্ষার্থীও পাচ্ছে না– এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে, আর্থিক দৈন্যে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েছে। করোনাকালে তহবিল সংকটে পড়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভবন ছেড়ে দিয়ে কোনোরকমে টিকে আছে। এমনকি কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তা পদে নানা কারণে নিয়োগ দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান।
তাই যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলো যৌক্তিক। প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই যেখানে ভালোভাবে চলছে না, সেখানে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ কেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেই কি শিক্ষার মান বাড়বে? এই যে যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার হিড়িক পড়েছে এর কারণ কী?
বেশিরভাগেই পঠন-পাঠন চলেছে নামকাওয়াস্তে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়মিত শিক্ষক নেই। চলছে ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র নজরদারি না থাকায়, অনিয়ম প্রতিরোধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন না মানার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক শাখা ক্যাম্পাস খোলা, শীর্ষ কর্তা নিয়োগে উদাসীনতা, বছরের পর বছর আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, অনুমোদনহীন কোর্স পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। কিছু দিন আগে ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসবের ৩৩টিতেই মাথা নেই, অর্থাৎ উপাচার্য নেই, ফলে এরা খাবি খাচ্ছে লেখাপড়া চালাতে। উপাচার্য নেই মানে মাথা না-থাকলে শরীরের যা হয়, উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তা-ই হচ্ছে। অর্থাৎ কোনও কাজই ঠিকঠাক হচ্ছে না। আর ৭৬টিতে নেই উপ-উপাচার্য এবং ৪৫টিতে কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম একদম ভেঙে পড়েছে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে বড় সমস্যায় পড়ছে, কারণ এরা হিসাব নয়ছয় করতেই মাসের পর মাস শীর্ষ পদগুলো ফাঁকা রাখছে। শিক্ষার্থীদের সনদপত্রে শুধু চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যই স্বাক্ষর করবেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বা অন্য কেউ স্বাক্ষর করলে সেই সনদও বৈধ হবে না। মস্তিষ্কের যথাযথ নির্দেশের অভাবে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ প্রায় অচল এসব প্রতিষ্ঠানে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা অ্যাকাডেমিক নন, বরং বলা চলে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী। মুদি দোকানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়কেও রোজকার আয়ের একটা দোকান হিসেবে দেখেন। এরা এখানে নানা প্রকার কেলেঙ্কারি করেন, নিজেদের মতো আইন চালু করেন, শিক্ষকদের স্বাধীনতা খর্ব করেন আর আর্থিক বিধিনিষেধ অমান্য করতে নিজস্ব কোনও ক্ষমতাই তারা অবশিষ্ট রাখেন না।
সরকারি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ঢুকেছে উৎকট, হানিকরভাবে আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে দুর্নীতি, অবৈধ বাণিজ্য আর বহু লজ্জাকর কেলেঙ্কারি, যা তাদের ব্যবস্থাকে দুর্বল করে প্রতিনিয়ত। দু’একটি বাদে প্রায় সবগুলোতে শিক্ষার পুরো কাঠামোটা বরবাদ করার উচ্চাভিলাষ এখন স্বাভাবিক বিষয়।
যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় বিস্তার চাই আমরা, তবে প্রয়োজন বিদগ্ধ বিদ্যোৎসাহী উদ্যোক্তা যারা এমন একটা কাঠামো দেবেন যেন যোগ্য উপাচার্যেরা ভালো কাজটা করতে পারেন। সেখানে ইউজিসির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলো আজ তার অস্তিত্বই বিপন্ন। কী সরকারি, কী বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই ইউজিসি যেন অনিয়মের নীরব দর্শক। লেখাপড়া চিন্তা-গবেষণায় এর প্রতিঘাত যে আসছে, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চুপ।
আমরা মনে করি অভিভাবক হিসেব আচার্যেরও দৃষ্টি থাকা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন কর্তৃত্বমুক্ত অস্তিত্বের অন্তিম রেশটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানচর্চায় প্রমাদ গুনতে দিতে পারি না আমরা। স্বচ্ছতা আর স্বাধীনতার অভাবে যে অনিবার্য ক্ষতি, তা বুঝে উঠবো কি আমরা? লেখাপড়া নষ্ট করে ক্ষমতা আস্বাদনের সুপ্ত বিলাস আর কতকাল চলবে?
লেখক: সাংবাদিক
Discussion about this post