সৈয়দ রিফাত
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালগুলোতে লাশের মিছিল আর হতাহতদের আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করেছে সমগ্র বিশ্ব। অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন ঘটনা নয়। সীতাকুণ্ড দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ যখন চলমান তখনো আরেক অগ্নিকাণ্ডে পাবনায় পুড়ছিল চারকোল কারখানা।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন একইভাবে রাজধানীর নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদাম থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ১২৩ জন। এক যুগ পার হলেও দেশে গড়ে উঠেনি অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সক্ষমতা বাড়েনি ফায়ার সার্ভিসেরও। ফলাফল—সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ অর্ধশতাধিক প্রাণহানি। তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ড, সাভারের রানা প্লাজা ধস, চকবাজার অগ্নিকাণ্ড সবক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি দুর্ঘটনা প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ততা। দেখেছি পর্যাপ্ত জনবল, সুরক্ষা সামগ্রী এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদির অভাবে কীভাবে একটি উদ্ধার অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অথচ এতগুলো বছর পরেও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতা কাটেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
অগ্নি-দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক শহরগুলোতে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা ফায়ার হাইড্রেন্ট। অর্থাৎ পানির একটি সংযোগ উৎস, যেখান থেকে দুর্ঘটনা চলাকালে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতগুলো ট্রাজেডির পরও দেশের কোথাও ফায়ার হাইড্রেন্টের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি দক্ষ জনবল, যুক্ত হয়নি অত্যাধুনিক কোনো সরঞ্জাম। ফলে দুর্ঘটনাকালীন বেশির ভাগ সময়েই ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ অবস্থা হয় উদ্ধারকর্মীদের। বর্তমানে সারা দেশে ৪৮৯টি ফায়ার স্টেশনের বিপরীতে দক্ষ—কার্যকর জনবল আছে মাত্র ১১ হাজারের মতো। অথচ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে ভিন্ন চিত্র।
জার্মানিতে ৯ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে অগ্নিনির্বাপক কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। আমাদের দেশে ভবন নির্মাণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় না অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাপনার কোনো শর্ত। রাইজার, স্পি্রং কলার, পর্যাপ্ত পানির মজুত, ফায়ার লিফটের মতো ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন নেই বেশির ভাগ বহুতল ভবনেই। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে একদিকে ভবনে অপর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং উদ্ধারকর্মীদের অত্যাধুনিক উদ্ধার সরঞ্জামের অপ্রতুলতা মিলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা খাতে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়লেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন উদ্ধারকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রীর বিষয়ে।
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সুরক্ষাসামগ্রী এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই উদ্ধার অভিযানে পাঠানো হয় উদ্ধারকর্মীদের। বৃহত্ অবকাঠামোগত উন্নয়নের চটকদার তত্পরতায় ক্ষুদ্র অবকাঠামোগুলো থেকে যায় শুভংকরের ফাঁকি। জীবন দিয়ে সেই ফাঁকির মাসুল গুনছে সাধারণ মানুষ। অগ্নি দুর্ঘটনা দেশের আর্থিক এবং অবকাঠামোগত ক্ষতিরও অন্যতম কারণ। সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডে আর্থিক ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকে সারা দেশে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার এবং আর্থিক ক্ষতি ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার বেশি।
তথ্যবিভ্রাট, তথ্য লোপাট এবং কর্তব্যে অবহেলা দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনাপরবর্তী বৃহত্ ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ। যে কোনো দুর্ঘটনায় নিজেকে বাঁচাতে মালিকপক্ষ প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। ফলে বেশির ভাগ উদ্ধার অভিযানেই উদ্ধারকারীরা পড়েন বিপাকে। এছাড়া দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতির কারণেও অসাধু মালিকপক্ষ সহজেই নিয়মবহির্ভূত কাজে আগ্রহ পেয়ে যায়। কেমিক্যাল থেকে সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও উদ্ধারকর্মীদের জানানো হয় কন্টেইনারে রয়েছে তৈরি পোশাক। অথচ দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে জানা যায়, সেখানে কেমিক্যাল মজুত ছিল যার কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না। কিছুদিন আগেও কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৩৮ যাত্রীর মৃত্যু দেখেছি আমরা। শুধু কর্তৃপক্ষের তথ্যলোপাট এবং দায়িত্বরতদের দুর্নীতির কারণে বেঘোরে প্রাণ যায় সাধারণ জনগণ, খেটে খাওয়া শ্রমিক এবং উদ্ধারকার্যে অংশ নেওয়া কর্মীদের। বিগত কয়েক দশকে অগ্নিদুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিস্ফোরক আইন-১৮৮৪ এবং সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১ তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। পর্যাপ্ত অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্হাপনা ছাড়াই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। ফলে জানমালের ক্ষতি বাড়ছে বহু গুণে। এমতাবস্হায়, দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং নিরাপদ শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি কারখানা এবং ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। করমুক্ত অগ্নি প্রতিরোধী সুরক্ষাসামগ্রী আমদানির ব্যবস্থা এবং স্বল্পমূল্যে সেগুলো সহজলভ্য করার উদ্যোগ নিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে যুক্ত করতে হবে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম এবং দক্ষ জনবল। সেই সঙ্গে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণা, সেমিনার এবং কর্মশালার মাধ্যমে অগ্নিনিরাপত্তা সচেতনতা এবং দুর্ঘটনায় করণীয় সম্পর্কে জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্হায় জোর দিতে হবে বেশি। প্রতিটি দুর্ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দাহ্যপদার্থ বহন এবং মজুতসংক্রান্ত প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতে নিয়মিত মনিটরিং এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। অতীতের দুর্ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্নিনিরাপত্তায় উদাসীনতা কাটিয়ে বাংলাদেশকে একটি অগ্নিদুর্ঘটনামুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার এখনই সময়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post