এ কে এম শামসুদ্দিন
দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি এই সেতু চালু হলে অতিরিক্ত ১ দশমিক ২৩ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়েই সমাপ্ত করা, স্থানীয় মূল্য সংযোজন করের সংগ্রহ বৃদ্ধি করা, করদাতা ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করা, টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঝুঁকিমুক্ত রাখা ইত্যাদিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাজেটে অগ্রাধিকার হিসেবে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে:
- সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নীত করা
- নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা
উক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে চাই সমন্বিত প্রচেষ্টা। জীবনযাত্রায় দেশের একটি অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পিছিয়ে থাকলে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে এ সমস্যা শিগগিরই সমাধান হতে চলেছে। এত দিন দেশের যে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল, সেই অঞ্চলের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র, তা হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তব রূপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৫ জুন শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে সবার জন্য পদ্মা সেতু উন্মুক্ত করে দেবেন। যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যোগাযোগব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উৎপাদিত পণ্যের সুষম বণ্টন, সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ, সমগ্র দেশের দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা ও দ্রুত শিল্পায়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয় ভৌত অবকাঠামো হিসেবে কাজ করে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। এ জন্য উন্নত যোগাযোগব্যবস্থাকে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা পালন করবে—সন্দেহ নেই।
পদ্মা ও যমুনা নদীর জন্য এত দিন বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ছিল না। ফলে উল্লিখিত অঞ্চলের অধিবাসীদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা ছিল এই নদী দুটি। যে কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ অঞ্চল দুটো তুলনামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকল উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির গতিপথ। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ নানাভাবেই লাভবান হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার দ্রুত উন্নতি ঘটে। এবার পদ্মা সেতুর জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি ঘটবে। উন্নত হবে জীবনযাত্রার মান এবং কর্মসংস্থানের জোগান হবে বহুগুণে। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেবে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনশিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু। এ ছাড়া এই সেতু ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশিয়া রেলপথের অংশ হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ হবে মোংলা ও পায়রা বন্দরের।
সেতুটি চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা সরাসরি সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হবে। এ অঞ্চলটি মূলত কৃষিপ্রধান। এত দিন এই অঞ্চলের কৃষিপণ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পরিবহনে যে সমস্যা হতো, তা লাঘব হবে। কৃষিজাত পণ্য ও কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ হবে। পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে।
দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি এই সেতু চালু হলে অতিরিক্ত ১ দশমিক ২৩ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। মোটকথা, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে মূলত তিন ধরনের সুবিধা বাড়াবে। প্রথমত, এই অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে বিনিয়োগও।
দ্বিতীয়ত, কৃষকেরা সরাসরি উপকৃত হবেন। তাঁদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রেরণ করতে পারবেন। তৃতীয়ত, অত্র অঞ্চলে ক্ষুদ্র থেকে ভারী শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, যা দেশের আর্থিক উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা Key Point Installation (KPI) হিসেবে গড়ে উঠেছে। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পদ্মা সেতু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থাপনা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, এসব জাতীয় স্পর্শকাতর স্থাপনার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশকে বলা হয় ‘ডিফেন্ডার প্যারাডাইজ’। এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের সম্পূর্ণ ভূখণ্ড তিনটি বড় নদী—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা দিয়ে বিভক্ত। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছোট-বড় নদী-নালা দিয়ে এমনভাবে বিভক্ত, যা যুদ্ধের সরঞ্জামাদি নিয়ে যেকোনো যুদ্ধবাজ সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট করা কষ্টকর। এসব নদী প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য সহায়ক। উভচর ট্যাংক দিয়ে ছোটখাটো নদী-নালা অতিক্রম করা সম্ভব হলেও পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতো বড় বড় নদী অতিক্রম করা অধিকতর দুরূহ। তা ছাড়া উভচর ট্যাংক যখন নদীতে ভেসে চলে, তখন তাদের গতি স্বাভাবিক কারণেই থাকে কম, তখন সহজেই সেসব ট্যাংককে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। ফলে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো সহজতর হবে না। ১৯৭১ সালে সম্ভব হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষের সার্বিক সহযোগিতার জন্য। বর্তমানে যমুনা ও পদ্মায় বৃহৎ দুটো সেতু হওয়ায় শত্রুপক্ষ যদি একবার দখল করে নিতে পারে অথবা যেকোনো উপায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যদি ধ্বংস করে দিতে পারে, তাহলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এ জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তাব্যবস্থা। এসব কথা বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু সেতু ও পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা রক্ষায় দুটি কম্পোজিট ব্রিগেড নিয়োজিত করা হয়েছে।
দেশের কেপিআইগুলোর নিরাপত্তার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদকালে ১৯৯৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল, যা ২০১৩ সালে ‘কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা-২০১৩’ নামে হালনাগাদ করা হয়েছে। সেই নীতিমালার ২.১-এ কোন কোন স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান কেপিআই হিসেবে বিবেচিত হবে; সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত কোনো প্রতিষ্ঠান/কারখানা/জনস্বার্থে ব্যবহৃত স্থাপনা, যেগুলো দেশের যুদ্ধ-সামর্থ্য অথবা জাতীয় অর্থনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের যুদ্ধ কিংবা প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বা জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়’। কেপিআইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে একই নীতিমালার ৩.১তে বলা হয়েছে, ‘কেপিআই সর্বদাই যেকোনো দেশে/জাতির অন্তর্ঘাতমূলক (Sabotage) কর্মকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্তর্ঘাত এমন একটি কৌশলগত কার্যব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একটি দেশ/জাতির সুরক্ষার ক্ষমতা দুর্বল বা ধ্বংস করা যায়। যুদ্ধ প্রতিরক্ষা একটি অপরিহার্য সর্বজনীন ব্যবস্থা, যা প্রতিটি দেশ ও জাতি গ্রহণ করে থাকে। প্রতিরক্ষা কেপিআইগুলোর সেসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সচেষ্ট থাকে, সেগুলো ধ্বংস হলে দেশের যুদ্ধ প্রতিরক্ষা ক্ষমতা হ্রাস পায়/বিনষ্ট হয়।’
একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ যেমন মঙ্গায় ভুগত। এখন আগের মতো আর মঙ্গার কথা শোনা যায় না। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তখন যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না বলে ছোট-বড় শিল্প-কারখানা তেমন স্থাপিত হয়নি। ফলে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও ছিল কম। কৃষিপণ্য পাঠানো ছিল কষ্টকর। অর্থের অভাবে সেখানকার দরিদ্র মানুষ তখন কোনোরকমে দিনাতিপাত করত। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো ক্ষুদ্র ও ভারী শিল্পের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এসব এলাকায় বেশ কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ওই সব এলাকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে, তাদের আয় বাড়বে এবং জীবন-জীবিকার মান আরও উন্নত হবে আশা করি।
এ কে এম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
Discussion about this post