মার্জিয়া লিপি
সরদার ফজলুল করিম- আমাদের কালের অসাধারণ মানুষ; আলোর পথযাত্রী। তিনি ভালোবাসতেন নিজেকে কৃষকের সন্তান বলে পরিচয় দিতে। এই পরিচয়ে স্মরণ করতেন উৎসের কথা। জানিয়ে দিতেন, উত্তর-জীবনে তাঁর সব পরিবর্তন, উত্তরণে জীবনের নিশান সততায় প্রোথিত।
জ্ঞানের শক্তিকে উপলব্ধি করেছেন নিজের মধ্যে। অপরকেও প্রভাবিত করতে চেয়েছেন সেই শক্তিতে। তাঁর স্বপ্ন, কর্ম, চিন্তার প্রবহমানতায় মহৎ জীবন সৃষ্টির সংগ্রামকে সমর্পিত করতে চেয়েছেন অনাগত প্রজন্মে। কালের পরিক্রমায় মানবসমাজে। ১১ বছরের জেলজীবন, ৫৮ দিনের অনশন, বিলেতে বৃত্তির আমন্ত্রণপত্র ছিঁড়ে ফেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া- এসব অভিজ্ঞতার কোনো কিছুই সরদার ফজলুল করিমের হিসাবে লোকসান নয়। তিনি মনে করতেন, তাঁর পুরো জীবনটাই লাভের।
১৯২৫ সালের ১ মে বরিশালের আটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সরদার ফজলুল করিম। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার, মা সফুরা বেগম। কৃষক পরিবারের চতুর্থ সন্তান, যিনি সর্বদাই নিঃসংকোচে স্মরণ করতেন ও সর্বদা বলতেন, ‘আমার দরিদ্র পিতা-মাতার দান করা জীবন নিয়ে এই পথটা হেঁটে এসেছি।’
বরিশাল থেকে ২০ মাইল উত্তরে উজিরপুর থানার আটিপাড়া গ্রামে শৈশব অতিবাহিত করেন। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষক বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতেন। আটিপাড়া বোর্ড স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু।
কাঠ-কয়লা গুঁড়া করে পানিতে মিশিয়ে তৈরি কালিতে বাঁশের কঞ্চির কলম ডুবিয়ে সেদ্ধ করা তালপাতার ওপর হাত ঘুরিয়ে বর্ণমালা অ, আ, ই, ঈ অক্ষর লিখতে শেখেন জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। বড় ভাই মৌজে আলী ছিলেন পথপ্রদর্শক। ১৯৩৮ সালে বড় ভাইয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরিশাল জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মেসে থেকে পড়াশোনা করেন ওই সময়ে। রাত ১০টা বাজলে ছাত্রাবাসের সব ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হতো। বালক সরদার তখন বই নিয়ে হোস্টেলের প্রাচীর টপকে চলে যেতেন পার্শ্ববর্তী জাহাজঘাটায়। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় গভীর রাত পর্যন্ত চলত তাঁর বই পড়া।
জিলা স্কুলে পড়ার সময়ে সংস্পর্শে আসেন তিনি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের (আরএসপি) সক্রিয় এক রাজনৈতিক কর্মী মোজাম্মেল হকের। মেধাবী সেই বন্ধুর কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি। মোজাম্মেল একদিন একটা বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন- ‘লুকিয়ে পড়তে হবে, কাউকে বলা যাবে না!’ এক রাতে গোপনে পাঠ করা ব্রিটিশ সরকারের নিষিদ্ধ সেই বই ‘পথের দাবী’ই সর্বপ্রথম সরদার ফজলুল করিমের চোখে স্বপ্ন জাগিয়েছিল।
বিপ্লবী স্বপ্নের বীজ রোপিত হয় বালক সরদার ফজলুল করিমের বুকে।
১৯৪০ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর বরিশাল থেকে জাহাজে চড়ে পুরান ঢাকার বাদামতলী ঘাটে এসে নামেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। জাতীয়তাবাদী, অর্থাৎ নন মুসলিম একটি গ্রুপের সঙ্গে হৃদ্য হয় তাঁর। কলেজে ছাত্রদের মধ্যে যে কমিউনিস্ট গ্রুপ ছিল, তারা দলে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাঁর ভাষায়, ‘ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমি যতটা না কমিউনিস্ট, তার চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী ছিলাম।’ সে সময়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন। হোস্টেলে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তোলেন।
রাত জেগে বিভিন্ন বই যেমন :পার্ল এস. বাকের ‘গুড আর্থ’ পড়তেন, যা তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও চরিত্র গঠনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। মুসলমানদের মধ্যে তাঁর আগে অন্য কোনো ছাত্র এ রকম কৃতিত্বপূর্ণ ফল করেননি।
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে তিনি সাম্যবাদী বামপন্থি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় নানা পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিগৃহীত হন। রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ ১১ বছর বিভিন্ন পর্যায়ে কারাজীবন যাপন করেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। জেল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দ্বিতীয় দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন।
বাংলা একাডেমির চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি সে সময়ে চলে দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধ্রুপদি সব গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, কোষগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, গ্রন্থ রচনা ও নানা বিষয়ে মৌলিক লেখা। সৃষ্টি করেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় রচনাসম্ভার।
অনুবাদ করেছেন দর্শনের অনেক মৌলিক গ্রন্থ- প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ ও ‘প্লেটোর সংলাপ’, অ্যারিস্টোটলের ‘পলিটিক্স’, এঙ্গেলসের ‘অ্যান্টি ডুরিং’, রুশোর ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’, ‘দি কনফেশান্স্’, ‘পাঠপ্রসঙ্গ’ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য মৌলিক সাহিত্য :চল্লিশের দশকে ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ :আলাপচারিতায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, রুমীর আম্মা, অনশনে আত্মদান, নানাকথা এবং নানাকথার পরের কথা, আর এক যুগে আর এক যুগোস্লাভিয়ায়, আমি মানুষ, আমি সরদার বলছি, নূহের কিশতী ও অন্যান্য প্রবন্ধ, গল্পের গল্প। দর্শন শিক্ষাকে সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাভাষীর জন্য রচনা করেছেন বাংলায় ‘দর্শনকোষ’।
বহুমাত্রিক সরদার ফজলুল করিম কল্পনা নন, বাস্তব। তাঁর স্বপ্ন, কর্ম, চিন্তার প্রবহমানতায় তিনি সমর্পিত হতে চেয়েছেন অনাগত প্রজন্মে। কালের পরিক্রমায় মানবমুক্তির ইতিহাসে। জ্ঞানতাপস সরদার ফজলুল করিমের দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তা এবং তাঁর সমগ্র বিপ্লবী জীবন বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য দ্রোহ ও প্রেরণার অনন্ত উৎস হয়ে থাকবে।
মার্জিয়া লিপি : লেখক, গবেষক ও পরিবেশবিদ
Discussion about this post