আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণার সময় জো বাইডেন জোর দিয়ে বলেছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসের কারণে সৌদি আরবকে একঘরে করা উচিত। কিন্তু মাত্র বছর দেড়েক পরেই চিন্তাধারায় নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে এখন উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। হোয়াইট হাউস সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী জুলাই মাসে ইসরায়েল-পশ্চিম তীরের পাশাপাশি সৌদি আরব সফরে যাবেন এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে দেখা করবেন। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর সৌদি যুবরাজের সঙ্গে এবারই প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ করবেন।
এতদিন মানবাধিকার বিষয়ে সৌদি আরবের রেকর্ড, ইয়েমেন যুদ্ধ এবং সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যায় সৌদি সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে এসেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান দাম এবং বৈশ্বিকভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা সেই অবস্থান বদলে দিয়েছে।
বাইডেনের সৌদি আরব সফরের খবর প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন জামাল খাশোগির বাগদত্তা। তিনি বলেন, যুবরাজ সালমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দেখা করার সিদ্ধান্ত আমাকে এবং সারা বিশ্বের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সমর্থকদের মারাত্মকভাবে হতাশ করেছে। বাইডেন এমবিএসের সঙ্গে দেখা করলে নৈতিকতা হারিয়ে ফেলবেন এবং আমার শোক ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলবেন।
যুবরাজ সালমানের সঙ্গে বাইডেনের সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্তকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেছেন সৌদি আরবের এক মানবাধিকারকর্মী। আর জ্যেষ্ঠ ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ইলিনয়ের ডিক ডারবিন বলেছেন, তেলের দাম ও মার্কিন জনগণের ওপর চাপ কমাতে সৌদি আরবের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি বুঝতে পারছেন। তবে সৌদির মানবাধিকার রেকর্ডের বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ রাজনীতিবিদ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইডেনের সৌদি সফর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, নীতিগত ক্ষোভের চেয়ে শেষপর্যন্ত বাস্তব রাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মূল কথা হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। আগামী নভেম্বরে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ অবস্থায় জ্বালানির চড়া দাম অবশ্যই ভালো ফল আনবে না। তাই তিনি মরিয়া হয়ে রুশ তেলের বিকল্প খোঁজ করছেন।
অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই সৌদি আরবের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ শুরু করেছিল বাইডেন প্রশাসন। এক্ষেত্রে মূল আলোচনা ছিল আট বছর ধরে চলা ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব বহু পুরোনো মিত্র। তবে ২০১৮ সালে সৌদি সরকারের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরে। মার্কিন গোয়েন্দোরা এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, যুবরাজ সালমানই খাশোগিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকারীরা ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর এ সাংবাদিকের দেহ টুকরো টুকরো করে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণার সময় বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি সৌদি আরবকে এর মূল্য চুকাতে বাধ্য করবেন এবং দেশটিকে একঘরে করে ছাড়বেন। নির্বাচনে জেতার পর তিনি খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং এতে জড়িত কয়েকজনের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দেন। তবে যুবরাজ সালমানের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ থেকেই স্পষ্ট, তিনি ঠিক কতদূর যেতে চান।
রিয়াদ-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাইডেনের বৈদেশিক নীতিতেও একটি মৌলিক দ্বিচারিতা প্রকাশ পায়, যার কেন্দ্রে রয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারবার স্বৈরাচারিতা ও গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আপন স্বার্থে তিনি সৌদি-ভেনেজুয়েলানদের মতো স্বৈরাচারীদের সঙ্গেও ব্যবসা করতে পিছপা হন না।
কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থা ও ইরানের মাধ্যমে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তার কথায়, মানবাধিকার এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের স্বার্থের সামগ্রিকতাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। সম্ভবত এই মানদণ্ড অন্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
সূত্র: এনডিটিভি
Discussion about this post