অনলাইন ডেস্ক
প্রতিবছরই এপ্রিল-মে এলেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এবছর জুনেও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। বজ্রপাত নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের তথ্য বলছে, আগের তুলনায় সম্প্রতি বজ্রপাত উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বেড়েছে হতাহতের সংখ্যাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বজ্রাঘাতে মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে অন্যতম বাংলাদেশ। কেউ বলছেন, বিশ্বে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে হচ্ছে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে হাওর ও বিল এলাকায়।
২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ২ হাজার ৮০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বজ্রাঘাতে। আহতের সংখ্যাও অনেক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাত বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন এবং ২০২১ সালে ৩৬২ জন মারা গেছেন বজ্রাঘাতে।
এই হিসাব অনুযায়ী, বছরে গড়ে ২৬৩ দশমিক ৫ জনের মৃত্যু হয় এই দুর্যোগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক অধ্যাপকের মতে, বিশ্বে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার এক-চতুর্থাংশ ঘটছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি এটা প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। কৃষিকাজের সময় ৭০ শতাংশ, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে এবং গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময় ১৩ শতাংশ মৃত্যুর তথ্য মিলেছে।
তিনি আরও জানান, বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বজ্রপাতের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বছর হিসেবে ধরা হয় ২০১৬ সালকে। মৃত্যুর সংখ্যার কারণে তার আগের বছরের ১৭ মে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
গেলো বছর বজ্রপাত নিয়ে ৪৭৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণের কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এর আওতায় বজ্রপাতের ৪০ মিনিট পূর্বে সতর্ক বার্তা দেওয়ার যন্ত্র কেনা, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং জনসচেতনতা তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ আফতাব উদ্দিন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে বজ্রপাতের হার বেশি। এর পেছনে অন্যতম কারণ তাপপ্রবাহ ও পশ্চিমা লঘুচাপের মিশ্রণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এবং অন্যদিকে হিমালয় থাকার কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর বজ্র-মেঘের সৃষ্টি হয়। মূলত মেঘের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ গঠন এবং সেই চার্জের আদান-প্রদানেই বজ্রপাত হয়।
বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা গরম ও আর্দ্র বাতাস এবং উত্তর থেকে আসা পাহাড়ি ঠান্ডা বাতাসের কারণে বজ্রপাতের ঘটনা বাংলাদেশে বেশি ঘটছে। এ ক্ষেত্রে আবহাওয়া বিষয়ক অনলাইনেও এর আগাম সতর্কতা পাওয়া যায়। আবার আবহাওয়ার গাণিতিক মডেল, কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ, রাডার ও মোবাইল সেবার বোধগম্য ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি কমানো যায়।
বিজ্ঞানীরা জানান, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায় ১২ শতাংশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার (১৭ জুন) বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) প্রণয়ন প্রকল্পের টিম লিডার অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নানা কারণে বজ্রপাতের ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যতম কারণ হলো- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাতাসের মুভমেন্ট ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত নিরোধ করা না গেলেও এতে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। বিশেষ করে প্রাক-সতর্কীকরণ ও বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করা উচিত।
ঢাবির দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এমন ঘটনা কমাতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতাও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে কালো মেঘ দেখলে খোলা স্থানে না থাকা, কাজ বন্ধ রাখা, বাড়ির আর্থিংয়ের ব্যবস্থা এবং উঁচু জাতের বৃক্ষরোপণ করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
Discussion about this post