শিক্ষার আলো ডেস্ক
ব্র্যাক ব্রিজ স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভারতীয়দের থেকে এগিয়ে বলে এক সমীক্ষায় জানা গেছে। ব্র্যাকের তত্ত্বাবধানে একদল আন্তর্জাতিক গবেষক ব্র্যাক ব্রিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়নের জন্য এএসইআর টুলস ব্যবহার করেছে, যেখান থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা বাংলা এবং গণিতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় এগিয়ে আছে। এই মূল্যায়নটি সম্পন্ন করা হয়েছে ২০২১ সালে, যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষার্থীরা শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে ছিল।
বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) ব্র্যাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
ব্র্যাক জানায়, ব্রিজ স্কুলের এই কোর্স কতটা কার্যকর ছিল, তা বুঝতে একটি গবেষণা করা হয়। প্রান্তিক অঞ্চল ও সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমিয়ে আনছে ব্র্যাক ব্রিজ স্কুল। এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির প্রফেসর জন রিচার্ডস ও ইউএসএআইডি’র সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম।
গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা যায়, ব্রিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছোট গল্প পড়ার দক্ষতা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি। ব্রিজের শিক্ষার্থীদের ভাগ অঙ্ক করার দক্ষতা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি, যা ২৮ শতাংশের তুলনায় ৬৩ শতাংশ। বিভিন্ন উপজেলা বা থানার মধ্যে তুলনা করে শিক্ষার্থীদের ছোট গল্প পড়ার ও ভাগ অঙ্ক করার দক্ষতার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায় বলে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে উল্লখ করা হয়। এছাড়া ভাগ অঙ্ক করার ক্ষেত্রে শহরের স্কুলের শিক্ষার্থীদের পারফরমেন্স গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশ খারাপ।
গবেষকদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. স্টিফেন হেইনম্যান বলেন ‘আমি ৬৫টি দেশে কাজ করেছি এবং অনেক স্কুল দেখেছি। আমি বলতে পারি, ব্রিজ স্কুলগুলো পরিষ্কার, রঙিন এবং একটি মনোরম শিক্ষার পরিবেশ দেয়। শিশুরা সেখানে থাকতে চায়। পড়াশুনা আনন্দময় হওয়া উচিত এবং এই স্কুলগুলোতে সব উপকরণ ছিল। পরিদর্শনের সময়, আমরা করোনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলাম এবং লক্ষ্য করেছি যে, শিক্ষকরা সবাই অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের ফোন ব্যবহার করেছেন এবং পড়াশুনা নিরীক্ষণ করতে শিখেছেন। এটি নিয়ন্ত্রণ এবং যোগাযোগের একটি স্তর, যা আমি কোথাও দেখিনি।’
কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির প্রফেসর জন রিচার্ডস বলেন, ‘ব্রিজ মডেলটি ওই শিশুদের লক্ষ্য করে বানানো হয়েছে, যারা সরকারি স্কুল থেকে ঝরে গেছে বা আর কখনও ভর্তি হয়নি। বেশিরভাগ শিশুই নিম্নআয়ের পরিবারের। বর্তমানে প্রায় ২০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে না। ব্রিজ স্কুলগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো যে, তারা বেশিরভাগ সরকারি স্কুলের তুলনায় ভালো পাঠদান ও গণিতে ভালো ফলাফল করেছে।’
ইউএস এইডের সাবে জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম জানান, ব্র্যাকের ব্রিজ স্কুলের চার মাসের কোর্সটি বিশ্বে অনন্য, কেননা, এটি ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় পড়াশুনায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পড়াশুনা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে। ব্রিজ স্কুল মডেলটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অনেক কার্যকর। যেসব দেশে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর হার একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেই সব দেশের জন্য এই মডেলটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন চার নম্বর লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করতে পারে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন— ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। তিনি বলেন, ‘‘মহামারি চলাকালীন স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে শিক্ষার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। পড়াশুনার ক্ষতি পুষিয়ে ঝরে পড়া এবং যাদের ঝড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব শিশুকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে মেয়ে, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য। আমাদের প্রমাণিত ব্র্যাক ব্রিজ স্কুলের মডেল এবং ব্র্যাকের শিক্ষা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের করা ‘শিক্ষার ক্ষতি’ বিষয়ক প্রতিবেদনের ফলাফল শিক্ষা ব্যবস্থাকে তরান্বিত করতে এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে নীতিনির্ধারক এবং অনুশীলনকারীদের উপকার করবে।’’
প্রসঙ্গত,সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে সারা দেশে শিক্ষা খাতে অগ্রগতির সঙ্গে এগিয়ে চলছে ব্র্যাক। ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম ২০১৪ সাল থেকে ‘ব্রিজ স্কুল’ নামে একটি উদ্ভাবনী মডেল চালু করে। প্রান্তিক অঞ্চল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়াশুনায় ব্যাপক পিছিয়ে পড়ে। যারা কখনও কোনও স্কুলে ভর্তি হয়নি বা প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রাথমিক স্কুল থেকে পিছিয়ে পড়েছে, তাদেরকে নিয়ে এনএফপিই (অ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা) কর্মসূচি পরিচালিত হয়। যাদের কিছু সাক্ষরতা ও সংখ্যার জ্ঞান রয়েছে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, তাদের একটি ব্রিজ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করে যোগ্যতা অনুযায়ী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়।
উল্লেখ্য, এই ব্রিজ মডেলে প্রাথমিকের পাঁচ বছরের কোর্সের অনুসরণ করা হয়। কিন্তু পুনরাবৃত্তি কমিয়ে স্বল্পতম সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা হয়। ব্রিজ মডেলে দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য একটি ‘চার মাসের’ ব্রিজ কোর্স আয়োজন করা হয়। ব্রিজ কোর্সের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ঘাটতিগুলোকে পূরণ করা এবং তাদের প্রাথমিক জ্ঞানকে তরান্বিত করা।
Discussion about this post