নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনা মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফেরেনি প্রায় ৪৩ লাখ শিক্ষার্থী। এ সময়ের মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিকের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং প্রাথমিকের ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কমে গেছে। এ ছাড়া এদের মধ্যে প্রায় ৩৩ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্র্যাক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে পড়াশোনায় শিশুদের পিছিয়ে পড়ার হার নির্ণয় করতে দুই ধরনের গবেষণা চালিয়েছে ব্র্যাক। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্টিফেন হেইনম্যান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক জন রিচার্ডস ও ইউএস এইডের সাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম। এ ছাড়া করোনাকালে ও করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা-পরবর্তী সময়ে স্কুল খোলার প্রথম মাসে প্রাথমিকের প্রায় ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৭৯ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফেরেনি, যা প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। করোনাকালে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৮০ জন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে না ফেরার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু না হওয়া, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিক্ষায় অনাগ্রহ, শিক্ষাবিরতি কাটিয়ে ওঠার ভয়, মাদ্রাসাশিক্ষায় যুক্ত হওয়া এবং বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়ার কারণে শিক্ষার্থীরা করোনা-পরবর্তী সময়ে আর বিদ্যালয়ে যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার পর শহর এলাকায় প্রাক্-প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রায় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে প্রাথমিকে কমেছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। প্রাক্-প্রাথমিকে মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমেছে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। অপর দিকে প্রাথমিকে ছেলেশিক্ষার্থী কমার হার বেশি দেখা গেছে। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে স্কুল খোলার পর শহর ও গ্রাম এলাকায় ছেলের চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে কওমি, হাফেজিয়া ও নুরানি মাদ্রাসায় ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে
বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরের মধ্যে এসব মাদ্রাসায় ৫ বছরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া ৬ থেকে ১০ বয়সী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ বলেন, ২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাক্ষরতা-দক্ষতা ছিল আনুমানিক ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী এটি এখন ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমে আনুমানিক ২৭ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। তিনি জানান, পড়তে, লিখতে ও সংখ্যা চিনতে পারা এবং সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারে এমন শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সমীর রঞ্জন নাথ আরও বলেন, ‘এই দুর্যোগের পর আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। তা না হলে ২০৩০-এর যে এসডিজি টার্গেট, তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব না। ২০০৮-এর শিক্ষা হার ২০২১-এ পাচ্ছি। অর্থাৎ আমরা শিক্ষায় ১৩ বছর পিছিয়ে আছি। আগামী ৮ বছরে আমাদের ২১ বছর এগোতে হবে। এর জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত “মেগা প্রজেক্ট” গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালক মু. নুরুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ইদানীং অনেক স্কুল পরিদর্শন করেছি। দুর্ভাগ্যজনক যে সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সংকটে ভুগছে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মো. মুহিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানাবিধ সংকট আছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু যেভাবে বলা হচ্ছে, তেমন আতঙ্কিত হওয়ার মতো না। গ্রামের দিকে এটি বেশি হয়েছে। তবে আমরাসহ সবাই তা পুষিয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা যদি আমরা উপলব্ধি না করি, তাহলে হয়তো আমরা একটা প্রজন্মকে হারাব। ব্র্যাক ব্রিজ স্কুলের যে ধারণা উদ্ভাবন করেছে, তার মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষার ধারায় ফিরে আসছে। সরকার ২০৪১-এ স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছে। শিক্ষায় জোর না দিলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।’
Discussion about this post