নিজস্ব প্রতিবেদক
আজ ১৪ জুলাই সাভার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৯৮ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী’র হাত ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে ১৫জন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালিত হচ্ছে। ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ৩২ একরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখানে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ও ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদের অধীনে ১৪টি বিভাগে পাঠদান চলছে। এই শিক্ষালয়ে ২৩১১জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন এবং শিক্ষকতা করছেন ১৬০জন শিক্ষক।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরী কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদন নিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। এই শিক্ষালয় বাঙালি সন্তানদের গৌরবের প্রতিষ্ঠান। আধুনিক যুগের চাহিদা মেটাতে ও তরুণ-তরুণীদের উচ্চমানের শিক্ষা উপহার দিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চতর শিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের একটি কেন্দ্র তৈরি করা। যা জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উৎসাহিত করবে। সমাজের চাহিদা, সামাজিক বিকাশ ও মানবকল্যাণে সাড়া জাগাবে। উচ্চমানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি, দূরদর্শী নেতা ও আলোকিত নাগরিক তৈরি করবে। এতে করে ব্যক্তিরা তাদের বৌদ্ধিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবে। ২৪ বছরের পথচলায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই এগিয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন। সবুজ ক্যাম্পাস আপন করে নিয়েছে সবাইকে।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আদর্শ মেনে এগিয়ে চলছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়। নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানের জন্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য, প্রতিবন্ধী এবং উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যয়ন, টিউশন ফি ছাড়সহ নানান সুযোগ সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প সময়ে সুনাম কুড়িয়েছে দেশের অন্যতম ব্যাতিক্রমী প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়, যার নীতিবাক্য- ‘ইউনিভার্সিটি উইথ এ ডিফারেন্স’। অলাভজনক ও ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠানের তকমা প্রাপ্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বললে প্রথমেই ভর্তির বিষয়ে বলা যায়। একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মেডিকেলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়, ধূমপায়ী, নেশাগ্রস্থদের ভর্তির কোন সুযোগ নেই। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের বই পড়ার জন্য পয়সা খরচ করে বই কিনে নিতে হয়, নিজস্ব লাইব্রেরিতে বই পড়ার জন্য সবসময় উদ্বদ্ধ করা হয়। সাঁতার, মোটরসাইকেল চালানো শিখে নিতে হয়।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্স নামক প্রাণী চিকিৎসা এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের বিষয়ের পড়াশোনার করার সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, ফিজিওথেরাপির মতো আনকমন বিষয়ে পড়ার সুযোগও রয়েছে।
করোনাকালীন সময়ে ড. বিজন কুমার শীল করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট প্রস্তুত করেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষাগারে। মানুষের সঙ্গে কথা বলা, বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ভার্চ্যুয়াল কাজে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন সুবিধা–সংবলিত রোবট (মিরা) তৈরি করেছে এখানকার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অন্ধ ব্যক্তির চলাফেরায় যাবতীয় সুবিধা সম্পন্ন আধুনিক ব্লাইড স্টিক উদ্ভাবন করছে এখানকার মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। গবেষণার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের দক্ষতায় এগিয়ে গবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার। এ ক্যাম্পাসের অপরূপ সৌন্দর্যে মন উৎফুল্ল হবে যে কারোর। শরৎে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের উলুফুলের শুভ্রতা মনে আনে প্রশান্তি। বর্ষায় বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সঙ্গে টুপুর টাপুর ধ্বনিতে শতগুণ অপরূপ সুন্দর হয়ে উঠে বংশী নদীর কোলঘেষা ছোট্ট ক্যাম্পাসটি। প্রাণোচ্ছ্বল এই ক্যাম্পাসে বৃষ্টি মানে এক অনন্য সতেজতা। বাদামতলার আড্ডা আর গানের আসরের টুংটাং গিটারের ছন্দে মেতে থাকে গোটা ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ।
একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে নানা গ্রামীণ উৎসবের আয়োজনও করা হয়। যেমন পিঠা উৎসব, বসন্ত বরণ, বৈশাখী উৎসব, ফল উৎসব, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। নানা রঙ বেরঙের আয়োজন থাকে বছরজুড়ে। শিক্ষার্থী পরিচালিত ১৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে সভা,সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) আয়োজনে ভোক্তা অধিকার ও ক্যারিয়ার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পিঠাপুলির দোকান এবং ক্যান্টিনে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা ও হৈহুল্লোড় লেগেই থাকে সারাদিন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসব উদযাপনের প্রাণকেন্দ্র হলো ট্রান্সপোর্ট চত্বর। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়, ছাত্র সংসদ কার্যালয়, সাংবাদিক সমিতি কার্যালয়, ডিবেটিং সোসাইটি কার্যালয়, ভর্তি অফিস,জলাশয়, টেনিস কোর্ট সব মিলিয়ে এ ক্যাম্পাসে আসলে আপনি হয়তো ভুলেই যাবেন এটি একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
নারী ক্ষমতায়নের জন্যও ব্যতিক্রমী হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে এই বিদ্যাপীঠ। ২০১৭ সালে নারী উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানুকে। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই যে কারো নজর কাড়ে মূল ফটকের দিকে। পরিচিত-অপরিচিত ১১ জন মহিয়সী নারীর ছবি মোজাইক করে বসানো হয়েছে সেখানে। যারা সবাই আজীবন কাজ করে গেছেন নারী মুক্তির জন্যে। সমাজ বদলে রেখেছেন ভূমিকা। যা দেখে উদ্বুদ্ধ হয় শিক্ষার্থীরা।
সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে বিশ্বাসী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূল ফটকে তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীদের কাজের সুযোগ প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গের ৬জন প্রহরীর দায়িত্বে আছেন। এরা যে সত্যিকার অর্থে মানুষ, এদের সাথে মিশলে যে তারা আপন করে নিতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ এই গণবিশ্ববিদ্যালয়। নারী শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অংশ নিলে ২৫% টিউশন ফি ছাড়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ এস. তাসাদ্দেক আহমেদ বলেন, ‘একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সহশিক্ষা কার্যক্রমে প্রাণবন্ত থাকে নব্বই দশকের এই বিদ্যাপীঠ। গণ বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ বর্ষে পদার্পণ করছে যা অন্তত আনন্দের ও গৌরবের।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোঃ আবুল হোসেন বলেন, ‘জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাঁথা নিয়ে ২৫ বর্ষে পা রাখছে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোভিড-১৯ আক্রান্ত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, শিক্ষার্থী উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা, গবেষণা ও সহশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলকে অভিনন্দন ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।’
Discussion about this post