আসিফ
আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এই গতিতে এক সেকেন্ডে সাতবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা যায়। সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট। এ কারণে আমরা বলতে পারি, সূর্য পৃথিবী থেকে ৮ মিনিট দূরে। এক বছরে আলো মহাশূন্যে পথ অতিক্রম করে ১০ লাখ কোটি কিলোমিটার। যে দূরত্বটি আলো এক বছরে অতিক্রম করতে পারে তাকে এক ‘আলোকবর্ষ’ বলে। এই একক পরিমাপ করে সময়ের নয়, বরং দূরত্বের। ১ আলোকবর্ষ সমান ৯ দশমিক ৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার।
আমাদের সূর্য হলো মিল্ক্কিওয়ে গ্যালাক্সির ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্রের একটি, যা কেন্দ্র থেকে ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে। আমাদের মিল্ক্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে সর্পিল অ্যান্ড্রোমিডা৩১ গ্যালাক্সির দূরত্ব হলো ২০ লাখ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ অ্যান্ড্রোমিডার এই আলোটি যখন রওনা দিয়েছিল, সেই সময়টা ছিল ২০ লাখ বছর আগে আমাদের প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভবেরও (৬ লাখ থেকে ১০ লাখ বছর) অনেক আগে। তেমনই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) মহাশূন্যের গভীরে হাজারো গ্যালাক্সির ছবি তুলে পাঠিয়েছে, যে দূরত্ব থেকে ওই আলো রওনা দিয়েছিল তা পৃথিবীর উদ্ভবের আগে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবিটা হলো গ্যালাক্সিগুচ্ছ ‘এসএমএসিএস-৭২৩’। মহাশূন্যের গভীর থেকে ‘এসএমএসিএস-৭২৩’-এর যে ছবিটা ওয়েব টেলিস্কোপে ‘ডিপ ফিল্ড’ ছবিতে ধরা পড়েছে, তা শুধু পৃথিবীর জন্মের আগের দৃশ্যই নয়; স্থানের দূরত্বেও ৪৬০ কোটি বছরের অধিক। পরিস্কারভাবেই আমরা সুদূর অতীতের দৃশ্যই ধারণ করেছি, যা চারশ ৬০ কোটি বছর আগের চেহারা দেখাচ্ছে।
আজ তাহলে এর চেহারা কেমন? সেটি জানা যাবে ওই একই নিয়মে চারশ ৬০ কোটি বছর পরে!
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কোয়াসারের ছবি আমরা আগে তুলতে পারলেও এই গ্যালাক্সিগুচ্ছের ছবি তুলতে পারিনি কেন? তার কারণ হচ্ছে ‘এসএমএসিএস-৭২৩’ থেকে ভেসে দীর্ঘ আলোক তরঙ্গ ধরার জন্য সূক্ষ্ণ সংবেদনশীল টেলিস্কোপ আমাদের ছিল না। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ৬ দশমিক ৫ মিটার চওড়া সোনার প্রলেপ লাগানো প্রতিফলক আয়না রয়েছে এবং আছে অতি সংবেদনশীল ইনফ্রারেড তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের যন্ত্রপাতি।
১১ জুলাই সোমবার নিউইয়র্ক সময় বিকেল ৫টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেছেন। পরে নাসা ছবির পুরো অ্যালবাম প্রকাশ করে। সেখানে রয়েছে ৫টা ছবি। প্রথম ছবিতে উজ্জ্বল রশ্মি বের হওয়া আলোর উৎসগুলো আমাদের মিল্ক্কিওয়ের নক্ষত্র। বাকি সব একেকটা গ্যালাক্সি। খেয়াল করলে দেখা যায়, সেগুলো হালকা করে বেঁকে আছে। কারণ এই ছবির কেন্দ্রে গ্যালাক্সির ঘন বসতি আছে এবং সে কারণে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর আলো বেঁকে গেছে। ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপের ‘নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (এনআইআরক্যাম)। সাড়ে ১২ ঘণ্টায় বিভিন্ন তরঙ্গের ইনফ্রারেড আলো নিয়ে ‘কম্পোজিট’; ছবিটি ধারণ করেছে এনআইআরক্যাম। ওয়েব যে ইনফ্রারেড তরঙ্গের ছবি তুলেছে তা হাবল টেলিস্কোপের ক্ষমতার অনেক বাইরে। বিভিন্ন ইনফ্রারেড তরঙ্গের এমন একটি ছবি তুলতে হাবল টেলিস্কোপের কয়েক সপ্তাহ সময় লাগত।
জেডব্লিউএসটি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, কানাডীয় মহাকাশ সংস্থা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত একটি মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এটিকে নাসার হাবল মহাকাশ টেলিস্কোপের উত্তরসূরি হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। এটির সাহায্যে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে মহাবিশ্বে বিরাজমান বস্তু ও সংঘটিত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। এর সাহায্যে ধারণকৃত অবলোহিত বিকিরণ চিত্রণে আজ থেকে ১৩২০ কোটি বছরেরও আগে (মহাবিস্টেম্ফারণের ৪০ থেকে ৫০ কোটি বছর পরে) মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সি ও আদ্যনক্ষত্রগুলো কীভাবে রূপ লাভ করেছিল, তা সম্ভবত জানা যেতে পারে। এ ছাড়া মানুষের বসবাসযোগ্য সম্ভাব্য বহির্গ্রহগুলো আবহমণ্ডলের খুঁটিনাটি বিষয় পরিস্কার হবে।
যেখানে হাবলকে নিকট-অতিবেগুনি, দৃশ্যমান আলো ও নিকট-অবলোহিত বিকিরণ বর্ণালি পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তার বিপরীতে ওয়েব অপেক্ষাকৃত নিম্নতর কম্পাঙ্কের পরিসীমার বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করবে, যার মধ্যে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দৃশ্যমান কমলা আলো থেকে শুরু করে মধ্য-অবলোহিত তরঙ্গগুলো অন্তর্ভুক্ত (শূন্য দশমিক ৬-২৮ দশমিক ৩ মাইক্রোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট)। ফলে এটি একই সঙ্গে হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও স্পিটজার মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (একটি শূন্য দশমিক ৮৫ মিটার ব্যাসের অবলোহিত দূরবীক্ষণ যন্ত্র) উত্তরসূরি। এর সংবেদনশীলতা ও সূক্ষ্ণতার জন্য মূল ও গৌণ মিরর বা দর্পণের তাপমাত্রা শূন্যের চেয়ে ২২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে বা ৫০ ডিগ্রি কেলভিন আছে।
১৯৯৬ সাল থেকে পরিকল্পিত এ প্রকল্পটি একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার ফল, যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা।
নাসার গডার্ড ফ্লাইট সেন্টার যন্ত্রটির নির্মাণ প্রচেষ্টার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং কানাডীয় মহাকাশ সংস্থাও এ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সব মিলিয়ে বিশ্বের ১৪টি দেশ ও ২৯টি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের ৩ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানির পাশাপাশি শত শত বিজ্ঞানী ও হাজার হাজার প্রকৌশলী এ প্রকল্পের ওপরে কাজ করেছেন। সব মিলিয়ে এখানে যাঁরা কাজ করছেন বা মেধা খাটাচ্ছেন তাঁরা বহু দেশের নাগরিক।
বস্তুত বিজ্ঞান একটা চলতে থাকা প্রক্রিয়া। হাবল, স্পিটজার হয়ে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ একটা অগ্রগতির ধাপ। হঠাৎ পাওয়া কিছু নয়। তাই এর মাধ্যমে আমাদের অর্জন কোনো একক দেশের নয় বা এভাবে প্রতিফলিত করা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই রাষ্ট্র্রনায়করা বুঝতে পারবেন। এগুলো পৃথিবীর মানুষের অর্জন হিসেবেই পরিগণিত হবে।
আসিফ: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত (সায়েন্স জার্নাল)
Discussion about this post