অনলাইন ডেস্ক
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল এক আশ্চর্য রকম মানুষ ছিলেন বটে! সহকর্মীদের চেয়ে একেবারেই অন্য রকম। সহকর্মীরা যখন প্রথামাফিক ধর্মচর্চায় ব্যস্ত ছিল, তিনি তখন গির্জার মাঠে গবেষণার নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে মিল থাকে, আবার বেশ খানিক অমিলও; সেটি তিনি খুব সিরিয়াসলি খেয়াল করেছিলেন। কী করে সন্তান বাবা-মায়ের নানা বৈশিষ্ট্য পায়, আর কী করেই বা পায় ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য- এমনতর প্রশ্ন তাঁর মাথায় কিলবিল করছিল।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মেন্ডেলকে আটটি বছর ধরে একা এবং অন্য কারও সহযোগিতা ছাড়া এক নিরলস ও জটিল গবেষণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁর কোনো সহকর্মীই জীববিজ্ঞানের গবেষক ছিলেন না যে, তাঁদের সাহায্য মিলবে। কোনো শিক্ষকের কাছ থেকেও এসব বিষয়ে পরামর্শ পাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ এটি শুধু তাত্ত্বিকই নয়; হাতে-কলমে গবেষণার ফলাফল থেকে সত্যকে নিংড়ে বের করে নেওয়ার বিষয়। নিজের চিন্তার ভেতর থেকে তিনি সাজিয়েছিলেন গবেষণার পরিকল্পনা; আরও সাজিয়েছিলেন গবেষণার মঞ্চ গির্জার মাঠের এক কোণে। যত্ন ও মমতায় মটরগাছগুলোকে বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ দিয়েছিলেন। নিজের হাতে প্রতিদিন উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন গভীর নিষ্ঠায়। বিস্তারিত তথ্য লিখে রেখেছিলেন যখন যা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। আপন মমতায় এক জাতের মটর ফুলের গর্ভমুণ্ডে ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন অন্য মটর জাতের পুষ্প রেণু। রেণুর ভেতর দিয়ে মটরগাছের স্ত্রী ফুলের গর্ভে পৌঁছে গিয়েছিল পিতার মধ্যে থাকা তথ্য। মায়ের গর্ভে জেগে উঠেছিল নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষা। তা থেকেই তৈরি হয়েছিল ভ্রূণ; তৈরি হয়েছিল সন্তান। রক্ষা হয়েছিল বংশধর। তার চেয়ে বড় কথা বাবা-মায়ের বৈশিষ্ট্য সঞ্চারিত হয়েছিল সন্তানে। কেবল তা মটরশুঁটিতে ঘটেছিল, তা নয়। ঘটে তা বটগাছ, মাছ, গরু-ছাগল ও মানুষে। এক কথায়, অন্য সব জীবেই। মেন্ডেলের গবেষণার মধ্য থেকে এসব কথা বেরিয়ে এসেছিল দ্ব্যর্থহীনভাবে। সে কারণেই তিনি দুটি অলঙ্ঘনীয় তত্ত্ব উপহার দিতে পেরেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বংশগতিবিদ্যার জনক।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের গূঢ়তম সত্যের সন্ধান দিয়েছিলেন মেন্ডেল। তিনি বলেছেন, যে কোনো বৈশিষ্ট্যের জিন আসে সন্তানে বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকেই। আবার যখন সন্তান নিজেই বাবা-মা হয় তখন এসব জিন আলাদা হয়ে যায় এবং তা আলাদা গ্যামেটে প্রবেশ করে। এর আগে অন্যান্য বিজ্ঞানী ভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন এ নিয়ে। তিনি সব তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছিলেন। গবেষণার উপাত্ত ঘেঁটে জানিয়েছিলেন, পিতা-মতার জিন সন্তানে যায় একেবারে স্বাধীনভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয়ে। এরই মাধ্যমে সন্তানে সৃষ্টি হয় বৈচিত্র্য। সে কারণেই একই বাবা-মায়ের সব সন্তান এক রকম নয়; বরং নানা দিক থেকে ভিন্ন।
জোহান মেন্ডেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন আধুনিক চেক প্রজাতন্ত্রের ব্রুনোতে, ১৮২২ সালের ২০ জুলাই। এখন থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে। একজন স্কুলশিক্ষক তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের খবর টের পেয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই। দারিদ্র্য যেন শিক্ষার অন্তরায় না হয়, সে জন্য গির্জায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিনা পয়সায় ভরণপোষণ ও পড়াশোনার সুযোগ একমাত্র গির্জাতেই মিলবে। ব্রুনোর গির্জায় ঠাঁই লাভ তাঁকে জীবনের কঠিন সংগ্রামের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল। পাদ্রি হিসেবে তাঁর নাম হয় ‘গ্রেগর জোহান মেন্ডেল’।
গির্জায় আসা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের দেখভালের দায়িত্ব মেন্ডেলের মনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে তিনি গির্জার স্কুলের বিকল্প শিক্ষকের কাজ নেন। সেটিই তাঁর ভাবনাকে পাখা মেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। শিক্ষকতার সনদের জন্য নতুন আইনের কারণে তাঁকে একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল এবং তাতে অকৃতকার্য হলে তাঁর সামনে বিজ্ঞানের এক অজানা জগৎ খুলে যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশনাবিষয়ক নতুন কোর্স শিখতে তাঁকে দুই বছরের জন্য ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনাতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তাঁর পদার্থবিদ্যা ও গণিত শেখার কাজ শুরু হয়েছিল। তার চেয়ে বড় কথা, উদ্ভিদের অঙ্গসংস্থানিক বিদ্যা ও শারীরতত্ত্ব এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে প্রখ্যাত উদ্ভিদবিদ ফ্র্যাঞ্জ আঙ্গারের অধীনে উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার সুযোগ লাভ করেছিলেন। ওই শিক্ষক কোষতত্ত্ব বিষয়ে একজন উদ্যমী গবেষক এবং ডারউইনপূর্ব জীব বিবর্তনবাদীদের সমর্থক ছিলেন। তাঁর উৎসাহেই মেন্ডেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে গির্জার মাঠের গবেষণার প্লটে নিমগ্ন হয়ে যান। মটরশুঁটির কয়েক বংশধর ধরে চলমান ওই গবেষণায় বলা যায়, প্রথমবারের মতো তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল বিশ্নেষণের জন্য জীববিজ্ঞানে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ ঘটালেন সার্থকরূপে। জীব গবেষণার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের সেই ব্যবহার দিনে দিনে আরও প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য হয়ে উঠল।
আট বছর ধরে মটরশুঁটি নিয়ে গবেষণা শেষে মেন্ডেল চাইলেন গবেষণার ফলাফল দর্শকের উপস্থিতিতে প্রকাশ করতে। ব্রুনোর স্থানীয় একটি বিজ্ঞান সংগঠনের দুটি সেশনে ১৮৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের ৮ তারিখে উপস্থাপনও করলেন। কিন্তু উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বলতে গেলে কোনো সাড়াই পাননি। কারণ গবেষণাটি ছিল সেই সময়ের তুলনায় বেশ অগ্রবর্তী। বরং শ্রোতাদের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ও অনুপাতের ব্যবহার দেখে। মেন্ডেল পরবর্তী সময়ে, ১৮৬৬ সালে গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল ৪৮ পৃষ্ঠার একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ আকারে জার্নালে প্রকাশ করেন এবং এর বেশ কিছু কপি বিখ্যাত সব ব্যক্তি ও লাইব্রেরিতে পাঠান। এ কারণেই ৩৫ বছর তো বটেই, এমনকি শতবর্ষ পরে হলেও তাঁর কর্মের স্বীকৃতি মিলেছে। তিনি বংশগতিবিদ্যার জনক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের তত্ত্বের সঙ্গে পরে আরও কত অজানা সব তথ্য যুক্ত করেছেন অন্যান্য বিজ্ঞানী! তাতে তাঁর মহিমা এতটুকুও ম্লান হয়নি। তিনি সত্য প্রকাশ করেছিলেন বাস্তবে ডিএনএ ও জিনের উপস্থিতির কথা না জেনেই। এসব তো চেনা-জানা শুরু হয়েছে আরও কত পরে; মেন্ডেলের তত্ত্ব প্রকাশের বহু পরে। যাকে দেখা যায় না পরোক্ষভাবে, সে জিনের কথাই তিনি বলেছিলেন। বলেছিলেন কীভাবে ক্রোমোজোমের স্বাধীন বিন্যাস জিনের পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে কোষের মধ্যে সৃষ্টি করে বৈচিত্র্য। ডারউইনের বিবর্তনবাদের অমীমাংসিত বিষয়েও মীমাংসা মিলেছিল সেসব গবেষণা আর তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। বস্তুত মেন্ডেলের আবিস্কৃৃত সত্যকে ধারণ করেই জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যার উন্মেষ। উন্মেষ আধুনিক জীববিজ্ঞানের।
মেন্ডেলের তত্ত্বের মূল ভাব অবলম্বন করে চলেছে বাস্তব ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন কর্মকাণ্ড। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ফসলের উন্নত জাত; সৃষ্টি হয়েছে পশুর কত ব্রিড ও হাইব্রিড এবং কত শত মৎস্য জাত! এসব নতুন জাত আর ব্রিড পাল্টে দিতে শুরু করেছে পৃথিবীর কৃষি গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসেই। তাঁর তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই কৃষির ঘটেছে রূপবদল। কৃষিতে ঘটেছে সবুজ বিপ্লবও। বেড়েছে কৃষি উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণমান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জানা সম্ভব হয়েছে ৬ সহস্রাধিক বংশগত রোগের কথা, যার এক-দশমাংশের চিকিৎসাও মিলছে এখন।
পৃথিবীর মানুষ গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের জেনেটিক্সকে অবলম্বন করে আরও কত নতুন ধারায় এ বিজ্ঞানের শাখা উন্মুক্ত করেছে! মানবকল্যাণে কতভাবেই না আজ এ বিজ্ঞানের প্রয়োগ শুরু হয়েছে! দিনে দিনে আরও কত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে! মেন্ডেলের জন্মের ২০০তম বর্ষে এক ভক্তের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রণতি। গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাঁর তত্ত্বের সুফল ভোগকারী শত শত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে।
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া :উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি
Discussion about this post