সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক
সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার বিদ্যে-বোঝাই বাবুমশাইয়ের বিদ্যের মতো শিক্ষায় কিছু জিনিস আছে, যা না থাকলে হয়তো কিছুটা ক্ষতি হয়, তবে তা অপূরণীয় নয়। কিন্তু এমন কিছু আছে, যা না থাকলে শিক্ষার ষোলো আনাই মিছে হয়ে যেতে পারে। তেমন একটি আবশ্যিক উপাদান হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষক ছাড়া নিজে নিজে শেখার যে প্রক্রিয়াকে বাংলায় আমরা ‘ব্যক্তিয়ায়িত শিক্ষা’ বলতে পারি, তা যতদিন শিক্ষার একমাত্র পদ্ধতি বলে বিবেচিত না হচ্ছে, ততদিন শিক্ষাক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের ভূমিকা একজন শিক্ষার্থীর চাইতে কোনো অংশে কম নয়। শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা যে আসলে কতটা, তা বোঝার জন্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ নাট্যকার পিটার ব্রুকের ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘দি এমটি স্পেস’ বইয়ের কথা স্মরণ করা যায়। সেখানে পিটার ব্রুক বোঝার চেষ্টা করেছেন, এমন কী আছে যা না হলে নাটক হয় না, অথবা এমন কী আছে যা না থাকলেও নাটক হতে পারে। যেমন তিনি বলছেন, যদি স্টেজ না থাকে আপনি নাটক করতে পারবেন। যদি মিউজিক না থাকে তাও আপনার পক্ষে নাটক করা সম্ভব। এমনকি লাইট, প্রপ্স, মেকআপ, কস্টিউম, সাউন্ড ছাড়াও আপনি নাটক করতে পারবেন। বিল্ডিং না থাকলে রাস্তায় গিয়ে পথনাটক করা যেতে পারে। আর হাল আমলে স্ট্ক্রিপ্ট ছাড়া নাটক তো হরহামেশাই হচ্ছে। তাহলে এমন কী আছে, যা ছাড়া নাটক হয় না?
পিটার ব্রুক দেখলেন, অভিনেতা বা অভিনেত্রী না থাকলে নাটক হয় না, আর লাগে দর্শক এবং অভিনেতা বা অভিনেত্রী ও দর্শকের মধ্যকার সম্পর্ক। এ ছাড়া অন্য যা কিছু আছে তা কেবল প্রয়োজনেই ব্যবহার করতে হয়। প্রয়োজন না হলে নৈবচ। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কেন রবিনসন বলেছেন, শিক্ষাক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। আর কিছু না থাকলেও চলবে; কিন্তু শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা হবে না। আরও লাগবে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্ক। যেখানে বোদ্ধা শ্রোতাদের নিয়ে সংগীতের আসর বসে, সেখানে গায়ক ও শ্রোতার মিথস্ট্ক্রিয়ায় যেমন শাস্ত্রীয় সংগীতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়; যোগ্য শিক্ষক ও আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ক্লাসেও তেমনই শিক্ষার পুরোনো বিষয়গুলো নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আমাদের শিক্ষকদের মান-সম্মানের যে ক্রমাবনতি হচ্ছে, তা এমনিতেই নানা ছোটখাটো ঘটনায় আঁচ করা যাচ্ছিল। কিন্তু গত ক’দিনের যে শিক্ষক হত্যা ও নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, তাতে শুধু শিক্ষকরা নন; পুরো দেশে সংবেদনশীল প্রত্যেক মানুষ শিউরে উঠেছেন। সক্ষমতার ব্যাপারটা কখনও পরিমাপ করা হয়নি। তবে সেটা যে কাম্য মানের চাইতে অনেক কম- এটা বোঝার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষকদের মানসম্মান ও সক্ষমতা, যেগুলো আবার পরস্পর নির্ভরশীল; তা নিম্নমুখী বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও চিড় ধরেছে। অর্থাৎ শিক্ষার মূল উপাদান হিসেবে যে তিনটি বিষয়ের কথা ওপরে আলোচনা করা হলো, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে তার ভেতর বাংলাদেশে সংখ্যা বেড়ে কেবল শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই যা কিছুটা উন্নতি হয়েছে, অন্য দুটি উপাদানের অবনতি হতাশাজনক।
শিক্ষকদের সক্ষমতার অভাবের স্পষ্ট দুটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে তাঁদের নিয়োগ। এনটিআরসির আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নিয়োগগুলো যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি। আরেকটি হচ্ছে, নিয়োগের পর সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত মোটিভেশন না থাকা। যে একটি মাত্র মোটিভেশন আছে তা হচ্ছে, একটি ইনক্রিমেন্ট, যা পাওয়ার জন্য বেশিরভাগ শিক্ষকই নামকাওয়াস্তে একটি বিএড সার্টিফিকেট জোগাড় করেন। চাকরিকালীন তাঁরা কিছু প্রশিক্ষণ পান। কিন্তু সেগুলো এতই স্বল্প সময়ের যে, তাতে তাঁদের সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁরা যে ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে স্ব-উদ্যোগে নিজেদের যোগ্য করে তুলবেন, সে ব্যবস্থাও নেই। মাধ্যমিক পর্যায়ে এতদিন তো পদোন্নতি ছিল না বললেই চলে; এখন একটি পদ বেড়েছে কিন্তু সেই পদোন্নতি পেতে হলে বয়স বাড়া ছাড়া আর যেহেতু বাড়তি তেমন কোনো যোগ্যতা লাগে না, বেশিরভাগ শিক্ষকই এই ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না। তবে এতদিন শিক্ষককেন্দ্রিক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় কিংবা খাতা-কলমের পরীক্ষা পদ্ধতিতে এই যোগ্যতার ঘাটতি সবার চোখে পড়ত না। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর সেটা প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
আগে শিক্ষক ছিলেন সক্রিয়, আর শিক্ষার্থী নিষ্ফ্ক্রিয়। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী আর নিষ্ফ্ক্রিয় থাকবে না এবং শিক্ষককে হতে হবে আরও সক্রিয়। আগে এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকতেন শিক্ষক; শিক্ষার্থী থাকতেন প্রান্তে। এখন শিক্ষার্থীকে কেন্দ্রে স্থাপন করে শিক্ষক নিজে প্রান্তে অবস্থান করবেন। এ জন্যই শিক্ষককে আগের চাইতে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। কারণ, কেন্দ্রে থেকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করা যত কঠিন; কেন্দ্রে না থেকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করা তার চাইতে বহু গুণ কঠিন।
যাই হোক, শিক্ষক যদি তাঁর ভূমিকা পালন করতে না পারেন, তাহলে তিনি তো আর সত্যিকার অর্থে শিক্ষক থাকছেন না। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার জন্য যে ধরনের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আবশ্যক, সেটাও তৈরি হবে না। তাহলে শিক্ষার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদানের মধ্যে থাকছে কেবল শিক্ষার্থী। শুধু শিক্ষার্থী দিয়ে তো আর শিক্ষা হয় না। ফলে যত দ্রুত সম্ভব যোগ্য মানুষকে শিক্ষকতার পেশায় নিয়ে আসতে হবে এবং বর্তমান শিক্ষকদের যোগ্যতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে শিক্ষার আর সব আয়োজনের ষোলো আনাই শেষ পর্যন্ত সেই বাবুমশাইয়ের বিদ্যের মতো মিছে বলে প্রমাণিত হবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক
Discussion about this post