মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
গোটা পৃথিবী এখন ৭৫০ কোটি মানুষকে নিয়ে একটি করোনার কারাগার। বিশ্বে এক যোগে এত সহজে অতিদ্রুত মানুষ মরতে পারে তা কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিটি মূহুর্তে চোখ ফেললেই দেখতে পাই আক্রান্ত আর মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়াবহ একটি সময় অতিক্রম করছে সারা বিশ্বের মানুষ।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে সমাজের সব পেশার লোকই করোনা মোকাবিলায় কাজ করছেন। করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে আছেন চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। এসব পেশাজীবীর মধ্যে বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের সুরক্ষার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে করোনার কবল রক্ষা পাচ্ছেন না চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, বাংলাদেশসহ বিশ্বে অনেক দেশেই এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়ে অনেক চিকিৎসক মারা গেছেন।
সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মঈন তিনিও দেশের এই ক্রান্তিকালে দুরে ঠেলে দেয়নি করোনা আক্রান্ত রোগীদের। নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য। যার ফলাফল ৫ এপ্রিল হয়েছেন করোনা আক্রান্ত। তার কয়েকদিন পরেই চলে যান না ফেরার দেশে। ডা. মঈন-এর মতো বিশ্বে যারা দেশের মানুষকে করোনো থেকে সুস্থ্য করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন ব্যক্তিদের স্যালুট।
গত রোববার (১৯-এপ্রিল) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পাঁচ চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া খুলনা মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসকের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতির কর্ণধার চিকিৎসকেরা এভাবে আক্রান্ত হতে থাকলে বাংলাদেশ বড় ধরণের হুমকির মুখে পড়তে পারে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির বিষয়টি সারা বিশ্বে এখন আলোচিত হচ্ছে। হাসপাতাল দ্রুত তৈরি করা সম্ভব হলেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা সম্ভব নয়।
একটু ভেবে দেখুন তো চিকিৎসকদের ভূমিকার কথা। একটু ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলেও আমরা তাদের শরণাপন্ন হই। আর করোনা খুবই ছোঁয়াচে প্রকৃতির। সেখানে এতো সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা সাধারণত অসুস্থ হলে আমাদের বাবা-মা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু সেবা-সান্ত্বনা পেয়ে থাকি যা আমাদের ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর মনে হয়। এই মরণব্যাধী করোনাতে আক্রান্ত হলে তার সবচেয়ে প্রিয় মা-বাবা থেকে শুরু করে কাউকে কাছে পায় না। সে সময় তার সেবাকারী সবচেয়ে আপন এবং কাছের মানুষটি হচ্ছে চিকিৎসক। বিশ্বের সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে দায়িত্ব পালন যাচ্ছেন দিন-রাত।
তাই চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডাক্তারদের পিপিই প্রদানের কোনো ধরনের ঘাটতি থাকতে পারবে না। কারণ, একজন ডাক্তার সংক্রমিত হলে অন্যরাও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিছুদিন আগেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বেশ কজন ডাক্তার তাদের এবং তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রণোদনার দরকার নেই, আমাদের দরকার সুরক্ষার। মরে গেলে প্রণোদনা দিয়ে কী করব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালের বাইরে তাদের বাড়িতে কিংবা সমাজের অন্য কোথাও থেকে সংক্রমিত হচ্ছেন। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন বিশ্রামহীন টানা অধিকসংখ্যক রোগীকে সেবা দিয়ে যাওয়ায়।
করোনাভাইরাসে দেশে স্বাস্থ্য সরঞ্জামের সংকটে উদ্বিগ্ন আছেন চিকিৎসকেরা। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশি প্রবসীরা। একদল তরুণের সমন্বয় উদ্যোগে ‘কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি’র ব্যানারে প্রবাসীদের সহযোগিতায় একটি ফান্ড তৈরি করে। সেই ফান্ডের ৪০ শতাংশ অর্থ থেকে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য সাত’শ সেট পিপিই বিনামূল্যে বিলি-বণ্টনের জন্য ঢাকা মেডিসিন ক্লাবের কাছে হস্তান্তর করে। বাকি অর্থ দিয়ে গরিব- অসহায়দের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবে কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা মনে করেন এর মাধ্যমে দেশের চিকৎসকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা রাখতে ভূমিকা পালন করবে এবং তার সাথে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরাও দ্রুত চিকিৎসা পাবে।
প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশের সকল সেবাধর্মী সংগঠন বা বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যা করোনা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখবে এবং দেশের সব নাগরিক করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারবে। আমাদের সুরক্ষিত রাখতে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এবং অন্য সরকারি কর্মকর্তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, এটা প্রশংসনীয়।
চিকিৎসা সেবাকে মানসম্মত রেখে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় দেখিয়েছে দারুণ সাফল্যও। করোনা প্রতিরোধে ফ্রণ্টলাইন যোদ্ধা চিকিৎসকদের ‘সেফটি ফাস্ট’ হতে হবে তাহলে আমাদের দেশও আল্লাহর রহমতে করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পারবে।:
Discussion about this post