মোহাম্মদ মকছুদ মালেক
বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে শৈশব ও যৌবনকালের মধ্যবর্তী সময়। এ সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত বয়ঃসন্ধিকাল। জীবন উন্নয়ন চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এ সময়। বয়ঃসন্ধিকালে লিঙ্গনির্বিশেষে সবারই শারীরিক, মানসিক, আবেময় ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ছেলেদের মানসিক পরিবর্তনের সময় কারও কারও ক্ষেত্রে মানসিক সীমাবদ্ধতা বা সমস্যা তৈরি হয়।
ছেলেদের আবেগময় অনুভূতি
- দুঃখবোধ
- উদ্বেগ
- মানসিক চাপ
- রাগ
আচরণগত অসংগতি
এ সময় ছেলেদের আবেগময় অনুভূতির কারণে তিন ধরনের আচরণগত অসংগতি দেখা যায়।
- আক্রমণাত্মক আচরণ
- বিঘ্নিত আচরণ
- ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ (ধূমপান, মাদকের অপব্যবহার, নিজের ক্ষতি, স্কুল থেকে ড্রপআউট)।
ছেলেদের মানসিক সমস্যা
বয়ঃসন্ধিকালে পরিবর্তন যেহেতু হয়, সেই পরিবর্তন থেকে ছেলেদের কিছু গুরুতর মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়।
- হতাশা
- আত্মহত্যার প্রবণতা
- বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া
- মানসিক ত্রুটি
- অযৌক্তিক বিশ্বাস
- আত্মসম্মানবোধের অভাব।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শরীরে হরমোনগত পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এই পরিবর্তনগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের অংশ হলেও যথাযথ তথ্য ও আলোচনার জায়গা না থাকার জন্য ছেলেদের মানসিকভাবে ধকল সহ্য করতে হয়। ভুল তথ্য ও না জানার কারণে এই পরিবর্তন তার মানসিক পীড়নের কারণ হয়।
যৌনাঙ্গের পরিবর্তন, বীর্যপাত, বিভিন্ন স্থানে চুলের বৃদ্ধি, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, ব্রণের সমস্যা ইত্যাদি বিষয় তার মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। এই পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে একই রকম হয় না। আবার তার চারপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও তার এই পরিবর্তনগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তনে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে বিশেষজ্ঞের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, যা পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে ছেলেরা পায় না। আবার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করলে অনেক সময় ব্যঙ্গবিদ্রূপের শিকার হতে হয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদের এই অস্বাভাবিকতা ছেলেদের শুধু শারীরিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে।
আচরণে পরিবর্তন
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের হরমোনগত পরিবর্তনের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে না পারার ফলে আচরণে বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা দেখা যায়। ফলে কখনো সে প্রচণ্ড আগ্রাসী আচরণ করে, কখনো চুপচাপ হয়ে যায়, কখনোবা তার আচরণ মুডের জন্য পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে অন্যরা তাকে বুঝতে পারে না আবার সে-ও অন্যকে বুঝতে পারে না। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এমন আচরণ বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের মাঝে কখনো কখনো প্রকট আকার ধারণ করে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ, মেজাজ হারিয়ে অন্যকে আঘাত করা, বিভিন্ন ধরনের আসক্তি, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়া ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরণে।
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেরা
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের সবকিছুই যে নেতিবাচক হয়ে দেখা দেবে তা নয়। সময়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এ সময় তারা–
- কাজের দক্ষতা অর্জন করে
- মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা পায়
- নিজেকে নিজের মতো করে গঠন করে
- নিয়ম ও স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা পায়
- ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়
- তার অপূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করছে এমন ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়ক ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। এই ভূমিকা পালনের অনেক রকমফের আছে। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘অনুমতি প্রদান’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন কাউন্সেলররা। বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করছে এমন শিশুদের মধ্যে সব সময় অভিভাবকদের আদেশ, উপদেশ, নিষেধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ সময় বিভিন্ন কাজে অভিভাবকদের অনুমতি দেওয়া বিশেষভাবে কার্যকরী। এ সময় ছেলেসন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের মনোভাব হওয়া উচিত:
- কোনো বিষয় সম্পর্কে না বা হ্যাঁ বলার আগে তুমি চিন্তা করতে পারো এবং তোমার ভুল থেকে তুমি শিখতে পারো।
- তোমার ইচ্ছার প্রতি তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো এবং নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারো।
- তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত কাজের পথ খুঁজে বের করতে পারো।
- তুমি কোনো বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারো।
- তুমি নিয়ম শিখতে পারো, যা অন্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করবে।
- তোমার যোগ্যতা কীভাবে কাজে লাগাতে হবে সে বিষয়ে ভাবতে পারো।
- আমার ভালোবাসা তোমার সঙ্গে আছে। আমার বিশ্বাস, তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে।
জীবনে যা যোগ করা প্রয়োজন
বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলেকে ভবিষ্যতের পুরুষ হতে হলে আগে তাকে মানুষ হতে শিখতে হবে এবং জানতে হবে। যদি মানুষ হওয়া যায়, তবেই প্রকৃত পুরুষ হওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো যোগ করা প্রয়োজন–
- লিঙ্গ, কর্ম, ধর্ম ও মননে বৈষম্যহীন মনের অধিকারী হওয়া
- ইতিবাচক ভাষার অধিকারী হওয়া
- দায়িত্বশীল হওয়া
- অনুভূতি ও চিন্তার সমতা করতে শেখা
- অধিকার ও বাস্তবতা বুঝতে শেখা বা কোনটি আমার অধিকার আর কোনটি অন্যের অধিকার, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করা
- প্রয়োজন ও বাস্তবতার পার্থক্য শেখা
- স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে বুঝতে শেখা।
অনুভূতি
অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে ছেলেদের রাগ প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হলেও ভয়, দুঃখ বা কষ্টের অনুভূতিকে অনুভবের অনুমতি দেওয়া হয় না বা নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে সবারই দুঃখ, রাগ, আনন্দ ও ভয়ের অনুভূতি থাকবেই। ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বা গ্রহণে সমস্যা হয়। হতাশা, কষ্ট, বিষণ্নতা বা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে তা সমাধানের পদক্ষেপ খুবই সীমিত, যা মানসিক সমস্যা তৈরি করে।
লেখক- সাইকোথেরাপিস্ট মনোবিকাশ ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
Discussion about this post