শিক্ষার আলো ডেস্ক
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের জিন বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো। সোমবার (৩ অক্টোবর) নোবেল কমিটি তার নাম ঘোষণা করে।মূলত বিলুপ্ত জিনোম এবং মানবজাতির বিবর্তন নিয়ে বিস্তর গবেষণার জন্য এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাকে।
কমিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শরীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। সোয়ান্তে প্যাবো মানবজাতির বিবর্তন নিয়ে আপাততদৃষ্টিতে এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন বলা চলে। তিনি বর্তমান সময়ের মানুষের বিলুপ্ত বংশধর নিয়ান্ডারথালের জিনোম সিকোয়েন্স করেন। তার এই অর্জনকে মানবজাতির অতীত নিয়ে করা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ গবেষণা বলে ঘোষণা দিয়েছে নোবেল কমিটি।
সোয়ান্তে প্যাবো ১৯৫৫ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। পরে তিনি নৃবিজ্ঞানে আরও বিস্তর জানার জন্য লাইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে গবেষণা শুরু করেন। তর বাবা সুনে বার্গস্ট্রোম ১৯৮২ সালে মেডিসিনের উপর নোবেল পুরস্কার জেতেন।
কী ছিল তার গবেষণায়?
নোবেল কমিটির বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, সোয়ান্তে প্যাবো মানুষের বিলুপ্ত আত্মীয়দের জেনেটিক কোড নির্ধারণের মতো কালজয়ী একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও তার নামের পাশে ডেনিসোভানের মতো চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের কীর্তিও যোগ হয়েছে। তার এই কাজের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব বিবর্তনের ইতিহাস এবং কীভাবে মানুষ এই সুন্দর গ্রহে ছড়িয়ে পড়েছে তা জানা যায়। এই সুন্দর পৃৃথিবীতে আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পূর্বসূরিরা বিলুপ্ত হওয়ার সময় হোমো সেপিয়েন্স কী আমাদের সফল হতে দিয়েছিল? প্রায় সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় তার আবিষ্কার ও গবেষণা থেকে।
১৯৯০-এর দশকে মানুষের জেনেটিক কোড নিয়ে ব্যাপক গবেষণার চলেছিল। কিন্তু সেকালে আদিম মানুষের তাজা ডিএনএ ছিল দুষ্প্রাপ্য। অধ্যাপক প্যাবোর আগ্রহ ছিল মানুষের পূর্ব-পুরুষদের পুরনো, অবনমিত এবং দূষিত জেনেটিক উপাদানের প্রতি। অনেকেই তার গবেষণার ধরন এবং নমুনা দেখে সেকালে উপহাস করেছিল। কারণ এর আগে কোনো গবেষক এতো পুরনো নমুনা নিয়ে কাজ করতে চাননি। আধুনিক যুগে অধ্যাপকের জন্য এই কাজটি ছিল মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়। এই গবেষণায় নেমে তিনি প্রথমেই ৪০ হাজার বছরের পুরনো হাড়ের টুকরা থেকে ডিএনএ সিকোয়েন্স করে সফল হন। আর হাড়ের ডিএনএ’র গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে, নিয়ান্ডারথালরা বেশিরভাগ ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় বসবাস করতো। তারা আধুনিক মানুষ এবং কথিত শিম্পাঞ্জি থেকে আলাদা ছিল। তার কাজটি থেকে আমাদের বিলুপ্ত পূর্বপুরুষদের পরিচয় কিছুটা হলেও উঠে আসে। নোবেল কমিটি বলেছে, পূর্বসূরিদের জিনগত পার্থক্য প্রকাশ করে যে, সমস্ত জীবিত মানুষ প্রাচীন মানুষদের তুলনায় আলাদা ছিল। তার এই আবিষ্কারের ফলে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, আধুনিক মানুষ ভিন্নভাবে বেড়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ আরও দেখায় যে ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে আগত মানুষদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মিল ছিল। এটি আমাদেরকে আরও জানায় যে, হোমো সেপিয়েন্সরা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত হয়ে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যৌন সঙ্গমের মধ্যদিয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে। আধুনিক মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ ডিএনএ নিয়ান্ডারথাল পূর্বসূরিদের সঙ্গে মিলে যায়।
ডেনিসোভান গবেষণা
মানুষের উৎপত্তি নিয়ে আগের সবচেয়ে সফল আবিষ্কার হয়েছিল ২০০৮ সালে। বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো আঙুলের হাড় খুঁজে পেয়েছিলেন। অধ্যাপক প্যাবো সেখানকার একটি ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি ওই নমুনা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে, এটি একটি অজানা হোমিনিন যা ডেনিসোভান নামে পরিচিত। পরে তিনি দেখতে পান যে, হোমো সেপিয়েন্সরা ওই ডেনিসোভানদের সাথেও বংশবিস্তার করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশের আধুনিক মানুষদের মধ্যে ৬ শতাংশ মানুষের ডিএনএ-এর সাথে ডেনিসোভানদের মিল রয়েছে।
যাই হোক, সোয়ান্তে প্যাবোর এই আবিষ্কার আমাদের পূর্বসূরি সম্পর্কে আগের চেয়েও বেশি ধারণা দেয় বলেই তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে তিনি এক কোটি সুইপিশ ক্রোনার পাবেন। আশা করা যায় তার গবেষণা আরও বিস্তৃতি লাভ করবে যাতে করে ভবিষ্যতে আমরা জানতে পারবো, কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়া হয়ে হিমশীতল সাইবেরিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ডয়েচে ভেলে, বিবিসি
Discussion about this post