সাইফুজ্জামান সুমন
সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ। দক্ষিণ এশিয়ার মাত্র ৫ হাজার ৭৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট একটি দেশ ব্রুনাইয়ের ক্ষমতাসীন সুলতান। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ছিলেন তিনি। কিন্তু ওই দশকের শেষের দিকে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের উত্থানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তকমা হারান এই সুলতান।
তারপরও বর্তমানে ব্রুনাইয়ের এই সুলতানের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ ব্রুনাইয়ের প্রধানমন্ত্রীও। অর্থবিত্ত আর শৌর্যবীর্যে নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছেন তিনি চাইলেই দুনিয়ার যেকোনও কিছু নিজ দরবারে হাজির করতে পারেন মুহূর্তে।
লন্ডনে পছন্দের এক নরসুন্দর আছে, যার কাছে তিনি চুল কাটান। এই চুল কাটার জন্য লন্ডন থেকে তাকে উড়িয়ে নেন ব্রুনাইয়ে। আর একবার চুল কাটার পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে দেন ২০ হাজার মার্কিন ডলার।
ইংল্যান্ডের স্যান্ডহার্স্টের রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নেওয়া আছে ব্রিটেনের প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারিরও। বিলাসবহুল জীবনযাপন আর অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বিশেষ পরিচিতি আছে ব্রুনাইয়ের সুলতানের। সোনার প্রতি তার অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে। যে কারণে নিজের সংগ্রহে থাকা বিলাসবহুল গাড়িও সোনায় মুড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে ব্রুনাইয়ের ক্ষমতায় আছেন হাসানাল বলকিয়াহ। ২০১৭ সালে নিজের শাসনামলের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছেন তিনি।
সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহকে নিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য জেনে নিন…
সোনায় মোড়ানো রোলস-রয়েস
ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিরল সব গাড়ির বৃহৎ এক সংগ্রহশালা রয়েছে ব্রুনাইয়ের সুলতানের। তার সংগ্রহে রয়েছে সোনায় মোড়ানো রোলস-রয়েস থেকে শুরু করে নিজের পছন্দের নকশায় বানিয়ে নেওয়া বিলাসবহুল সব গাড়ি। তার সোনায় মোড়ানো গাড়ির ছবি প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
কয়েকশ ফেরারি
হটকারসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ ৬০০টি রোলস-রয়েস, ৪৫০টি ফেরারি এবং ৩৮০টি বেন্টলিজ গাড়ির মালিক। তার এই গাড়ির সংগ্রহের মূল্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। হাজি হাসানাল বলকিয়ার সংগ্রহে রয়েছে ৭ হাজারের বেশি যানবাহন। সোনায় মোড়ানো রোলস-রয়েস ছাড়াও অনেক বিরল গাড়িও রয়েছে তার। এর মধ্যে রয়েছে একটি ধূসর ল্যাম্বরগিনি উরাকো, একটি ফেরারি ৪৫৬ জিটি ভেনিস (বিশ্বে মাত্র সাতটি এমন গাড়ি রয়েছে) এবং একটি পোরশে ৯৫৯।
জিকিউ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আসলে তার গাড়ির সংগ্রহ এতই আকর্ষণীয় যে, ১৯৯০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া সব রোলস-রয়েসের অর্ধেকই ব্রুনাইয়ের সুলতান এবং তার পরিবারের দখলে বলে ধারণা করা হতো। ২০১১ সালে গিনেস কর্তৃপক্ষ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রোলস–রয়েস গাড়ির মালিক হিসেবে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
পিলে চমকে যাওয়ার মতো ব্যক্তিগত বিমান
যখন আপনার সোনায় মোড়ানো ছাদখোলা গাড়ি থাকবে, তখন ব্যক্তিগত বিমান যে পিলে চমকে যাওয়ার মতো হবে সে বিষয়ে বাজি ধরতেই পারেন। জন্ম থেকে ধনকুবের বনে যাওয়া ব্রুনাইয়ের সুলতানের নিজস্ব বোয়িং ৭৪৭-৪০০, বোয়িং ৭৬৭-২০০ এবং এয়ারবাস এ৩৪০-২০০ বিমান রয়েছে।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোনায় মোড়ানো এই বিমানের মূল্য ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্রুনাইয়ের সুলতান তার মেয়ের জন্মদিনে একটি এয়ারবাস এ৩৪০ উপহার দিয়েছিলেন।
১৭০০ কক্ষের প্রাসাদ; যা বিশ্বে বৃহত্তম
সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহর প্রাসাদ ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেসে রয়েছে ১ হাজার ৭৮৮টি কক্ষ, ২৫৭টি বাথরুম এবং পাঁচটি সুইমিং পুল। গাড়ির প্রতি আসক্ত এই সুলতানের প্যালেসে রয়েছে ১১০টি গ্যারেজ। তবে ঘোড়াও পছন্দ করেন তিনি। ঘোড়ার পরিচর্যা আর দেখভালের জন্য রয়েছে বিশাল এক কর্মীবাহিনী। ঘোড়ার জন্য বানানো ঘরে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
২ লাখ বর্গমিটারের বেশি বিস্তৃত এলাকায় নির্মিত ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেসকে বিশ্বের বৃহত্তম আবাসিক প্যালেস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ। গিনেসের তথ্য অনুযায়ী, সুলতানের এই প্যালেসের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ১৯৮৪ সালে। সেই সময় এই প্যালেস নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ব্যয়বহুল চুলের ছাঁট
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিপাটি থাকার জন্য অর্থ ব্যয়ে কোনও কার্পণ্য করেন না সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ। একবার চুল কাটার জন্য নরসুন্দরকে ২০ হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেন তিনি। ব্রিটিশ এই দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, নিজের পছন্দের নরসুন্দরকে নিয়মিত লন্ডনের মেফেয়ারের ডরচেস্টার হোটেল থেকে ব্রুনাইয়ে উড়িয়ে নিয়ে যান সুলতান। প্রত্যেক বার এই নরসুন্দরকে নগদ অর্থ দেন তিনি।
সুলতানের শিল্প প্রেম
ইনসাইডারের মতে, শিল্পের প্রতিও ব্রুনাইয়ের সুলতানের বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। ফরাসি শিল্পী পিয়েরে-অগাস্ট রেনোয়ারের আঁকা পিয়ানো বাজানো দুই তরুণীর একটি তৈল শিল্পচিত্র ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনেছেন সুলতান।
বলকিয়াহর জন্ম
ব্রুনাইয়ের সুলতান তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিনের ছেলে বলকিয়াহর জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ জুলাই। সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিনের একাধিক স্ত্রী ছিল। তাদের ঘরে মোট ১০ সন্তান জন্ম নেয়। এর মধ্যে ছয়জন মেয়ে এবং চারজন ছেলে। সন্তান দশজন হলেও বলকিয়াহকে উত্তরসূরী হিসেবে অল্প বয়সেই বেছে নেন তার বাবা।
বলকিয়া ১৯৬৮ সালের আগস্টে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এখন পর্যন্ত বিয়ে করেছেন তিনটি। বিচ্ছেদ ঘটেছে দুবার।
প্লেবয় তকমা
বিবাহিত এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও বলকিয়াহ তার যৌবনকাল কাটিয়েছেন উন্মত্ত এক দুনিয়ায়। নিজের জীবন উপভোগের পথে বিয়ে বা একাধিক স্ত্রী তার জন্য কখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পশ্চিমা বিশ্বের সুন্দরী তরুণীদের নিজ প্যালেসে এনে রাত কাটানোর অভিযোগ রয়েছে এই সুলতানের বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এবিসি একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে। হাজি বলকিয়াহকে এই তথ্যচিত্রে উপস্থাপন করা হয় ‘দ্য প্লেবয় সুলতান’ শিরোনামে।
আছে নিজস্ব চিড়িয়াখানা
ব্রুনাইয়ের সুলতানের নিজস্ব চিড়িয়াখানা রয়েছে— যেখানে ঠাঁই হয়েছে ৩০টি বেঙ্গল টাইগারের। চিড়িয়াখানায় শো আয়োজনের মাধ্যমে ব্রুনাই সফরকারী বিশ্ব নেতাদের বিনোদন দেন সুলতান।
এই চিড়িয়াখানায় বাজপাখি, ফ্লেমিংগো ও কাকাতুয়া রয়েছে। আর এসব পাখি বাস্কেটবল খেলা, বাইসাইকেল চালানো, গান পরিবেশন, কথা বলা এবং অন্যান্য পশুপাখিকে অনুকরণও করতে পারে বলে সুলতানের চিড়িয়াখানার এক রক্ষক দ্য ব্যাঙ্কক পোস্টকে জানিয়েছেন।
হেরেম খানা
সুলতান প্রায়ই তার ভাই প্রিন্স জেফরির অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন ঘিরে বিতর্কের মুখেও পড়েছেন। আশি এবং নব্বইয়ের দশকের দিকে প্রিন্স জেফরি ইস্তানা নুরুল ইমাম প্যালেসে হেরেম খানা খুলে বসেন। আকর্ষণীয় আর লাস্যময়ী ৪০ তরুণীকে নিয়ে এই হেরেম খানায় মেতে থাকতেন জেফরি।
‘সাম গার্লস: মাই লাইফ ইন আ হারেম’ শিরোনামে লেখা একটি বইয়ে মার্কিন তরুণী জিলিয়ান ল্যরেন বলেছেন, নিজের হেরেম খানার জন্য তাকে নিয়োগ করেছিলেন প্রিন্স জেফরি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে নিউইয়র্ক থেকে তাকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ব্রুনাইয়ের সুলতান বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও হেরেম খানার তরুণীদের সাথে রাতে ঘুমাতেন বলে অভিযোগ করেন জিলিয়ান ল্যরেন। ২০১৪ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ল্যরেন বলেছিলেন, সুলতান মদ্যপান করেন হেরেম খানার তরুণীদের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতেন এবং আমি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। যদিও পরবর্তীতে এক বিবৃতি দিয়ে ব্রুনাইয়ের সরকার সুলতানের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে।
ডেইলি মেইল, ইনসাইডার, সিএনএন, এপি, দ্য টাইমস অবলম্বনে…
Discussion about this post