ড. তাপস কুমার বিশ্বাস
মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষার দুরবস্থা (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)। প্রতিবেদনে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বালিয়াজুরি হাজী এলাহী বক্স উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান চিত্র বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়েছে। যা শুধুমাত্র হতাশাজনকই নয়, রীতিমতো আশঙ্কার উদ্রেক করে।
বিজ্ঞান শিক্ষা যদি এভাবে চলতে থাকে এবং এর গুরুত্ব বিবেচনা করে অতিরিক্ত প্রাধান্য না দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেই যাত্রায় নিশ্চিতভাবেই হোঁচট খেতে হবে, এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের কল্যাণেই আমরা আজকের পর্যায়ে অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছি। ষোড়শ শতকে ইউরোপের রেনেসাঁ, রিফরমেশন এবং এনলাইটেনমেন্ট থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শিল্প বিপ্লব, ৭০-৮০ দশকের কৃষি বিপ্লব থেকে নিয়ে অধুনা তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের সমস্ত কিছুই বিজ্ঞানের কল্যাণে সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে যা কিছু উন্নয়ন বা অগ্রগতি আমরা দেখতে পাচ্ছি তার সিংহভাগই যে বিজ্ঞানের অবদান তা বলাই বাহুল্য। যে জাতিই আজকে উন্নয়নের শীর্ষে অবস্থান করছে, খেয়াল করে দেখলে স্পষ্ট হবে, তারাই বিজ্ঞানকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছে।
ইউরোপ, আমেরিকা তথা আমাদের এশিয়া মহাদেশের মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশগুলো বিজ্ঞান শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে তাদের দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
ইউরোপ, আমেরিকা তথা আমাদের এশিয়া মহাদেশের মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশগুলো বিজ্ঞান শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে তাদের দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় যখন বিজ্ঞানকে এভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের দেশে বিজ্ঞানকে দিন দিন যেন পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখিত প্রতিবেদনে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবহারিক নিয়ে তারই স্পষ্টতা প্রতীয়মান হয়েছে।
খোঁজ নিলে জানা যাবে, বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান পড়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা বা অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ছে না বা আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রান্তিকে এই ধারা আরও প্রবল। শুধু বিজ্ঞান শিক্ষা নয়, বিজ্ঞান গবেষণাগার, আইসিটি ল্যাবরেটরির অবস্থাও বেশ ভয়ানক।
বিজ্ঞান শিক্ষকদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য যোগ্য শিক্ষকের অভাব এবং যারাই বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তাদের উক্ত বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে।
বিজ্ঞান শিক্ষার এই অবস্থা হওয়ার কারণ কী? এবং এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী? মাধ্যমিক পর্যায়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে যা বোঝা গেল, তা হলো বিজ্ঞান পড়ার মতো অনেক বিদ্যালয়েরই যথাযথ পরিবেশ নেই। যথাযথ পরিবেশ বলতে যা জানা গেল, ব্যবহারিকের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।
শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তথা আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। ব্যবহারিক অনুশীলনের ব্যবস্থা না থাকায় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাতে-কলমে শেখার কোনো সুযোগ নেই অনেক ক্ষেত্রেই।
ব্যবহারিকের জন্য তেমন কোনো কার্যক্রমও নেওয়া হয় না বছরের বেশিরভাগ সময়। শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তথা আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। ব্যবহারিক অনুশীলনের ব্যবস্থা না থাকায় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাতে-কলমে শেখার কোনো সুযোগ নেই অনেক ক্ষেত্রেই।
এছাড়া অনেকের মতে, বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এবং দেশে চাকরির বাজারেও বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের বাড়তি তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণেও অনেকে বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমনকি যারাও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান পড়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে তাদেরও বড় একটা অংশ পাস করার পর ইদানীং চাকরি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ছেড়ে প্রশাসন বা অন্যান্য দিকে চলে যাচ্ছে।
বিসিএস-এ বহু ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের এরকম প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি। বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের যখন এরকম অবস্থা তখন আমাদের সত্যিই ভাবার সময় হয়েছে এর থেকে উত্তরণের উপায়। বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে করণীয়—
- বিজ্ঞান শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করতে হবে।
- প্রতিটি বিদ্যালয়ে আইসিটি ল্যাব করতে হবে।
- প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
- এমনকি ব্যবহারিক কার্যক্রমের পরিচালনার মাধ্যমে তথা হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।
- বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির সুব্যবস্থা বা পর্যাপ্ত সুযোগ করতে হবে।
- চাকরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নতুন বিশেষায়িত ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে।
- সর্বোপরি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে।
বিজ্ঞান শিক্ষাকে অবহেলা করে কোনো জাতি আজ অব্দি উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। সুতরাং আমাদেরও সময় এসেছে কেন বিজ্ঞান শিক্ষা দিন দিন দুরবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে তার সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করা এবং তার যথাযথ সমাধান বের করা।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই কাজ দ্রুততম সময়ে করার মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞান শিক্ষাকে বর্তমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করতে পারি।
ড. তাপস কুমার বিশ্বাস । অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post