ডা. তারেক কাওসার ,সিওমেক (৫৪তম ব্যাচ)
সময়টা বেশ উওাল, মাত্র সামরিক শাসনের সূচনা হয়েছে। সব কিছুতে কড়াকড়ি যেন, কোনো জায়গায় খুব বেশি মানুষের এক সঙ্গে হওয়ার সুযোগ নেই। এর মধ্যে হুট করে ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী। মহানায়কের প্রস্থানে শুধু সিলেট নয়, দেশজুড়ে যেন শোকের আবহ।
এই প্রবল বেদনায় ভারাক্রান্ত ২৪ বছরের টগবগে জুয়েল সাহেব হটাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে ভাবলেন তিনি কিছু একটা করবেন। উনার বন্ধুকে ভাবনা বলার সাথে সাথে তিনিও রাজি হলেন। ছুটলেন সিলেট বিমানবন্দরের দিকে যেনো দিনের আলোতেই মিশন শেষ করা যায় এবং উদ্দেশ্যও সফল হলো। এবার ভাবলেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও একই কাজ করবেন।
হটাৎ মনে হলো, উনার বন্ধু আদিলুজ্জামান আদিল ফিফথ ইয়ারে সিলেট মেডিকেলে আছেন। ছুটলেন বন্ধুর কাছে, বন্ধু আদিলও রাজি। রাতের মিশনে উনারা মেডিকেলের ফটকের সামনে গেলে ভালো লিখতে পারে—এমন একজনকে দরকার মনে হলো।
তৎক্ষণাৎ উনাদের বন্ধু শাহাজাহান সাহেবকে ডাকলেন। এসেই শাহাজাহান সাহেব লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু বিপওি বাধলো এতো উপরে উঠবেন কি করে! কাছেই গার্ডকে জানালে তিনিও রাজি হলেন এবং জানালেন তার চাকরি থেকে ওসমানী সাহেবের সম্মান অনেক বড়। সাথে সাথে হসপিটাল ট্রলি ও টুল এনে দিলেন। শাহজাহান সাহেব একে একে লিখছেন ‘ও’, ‘স’ ইত্যাদি। তারপর উনাদের দুই বন্ধু সেগুলো খুব সুন্দর করে বসানো শুরু করলেন। এবার নাম হলো ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
মিশন শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে তিন বন্ধু আদিলুজ্জান, জুয়েল ও শাহাজাহান এবং গার্ড মামা আগামীকাল সকালে কি বিশাল সামরিক ফরমান আসবে তার চিন্তা করছিলেন।
রাতের আঁধার ও ভোর কেটে সকাল হলে পুরো সিলেট শহরে হই হুল্লোড় পড়ে গেলো। সিলেট মেডিকেল কলেজ ও সিলেট বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। কলেজের বিখ্যাত খালিক স্যার একদিকে ছাত্র স্নেহশীল আবার চাকরির প্রতি অনুগত। এর মধ্যেই চলে আসলো সামরিক ফরমান, এই কাজ যারা করেছে তাদের গ্রেপ্তার করবে। এদিকে জুয়েল সাহেবের মামা নৌ প্রধান মাহবুব আলম হওয়ায় টুকটাক ক্যান্টেনমেন্টে যাতায়াত থাকায় উনাকে কিছু অফিসার কৌশলে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় রাখলো, কিন্তু বিপওি বাধলো উনাদের বন্ধু আদিলকে নিয়ে। অবশেষে অধ্যক্ষ খালিক স্যার উনার ছাত্র আদিলুজ্জানকে ওয়ার্ডে ভর্তি করে সার্টিফিকেট দিলেন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই এই কাজের জন্য উনাকে আসামি করা যাবে না। কিন্তু সরকারি আইন তা তো পিছু ছাড়ছে না কারও।
এর মধ্যে জেনারেল ওসমানীর লাশ দেশে এসে পৌঁছালো এবং সিলেটসহ সারাদেশের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে চতুর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ পরের দিন সকালে বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন ওসমানি উদ্যান, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর নামকরণ করবেন।
পরবর্তীতে আমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ নামকরণ হয় এবং তৎকালীন চার যুবকের একজন আদিল সাহেব হোন ফরেনসিক মেডিসিনের বিখ্যাত প্রফেসর। শুধু তাই নয়, ফরেনসিক মেডিসিনে আদিল স্যার আমাদের সিওমেকে বেশ দীর্ঘ কাটিয়ে ও মাতিয়ে রেখেছিলেন উনার ছাত্রদের।
১৯৩৬ সালে শহরের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখে। দেশভাগের পরে ১৯৪৮ সালে মেডিকেল স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের ২২ অক্টোবর প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু করে। আজ সেই প্রাঙ্গণ ৬০ বছরে পদার্পণ করছে।
এই দীর্ঘ সময়ে বিশাল আয়তনের ক্যাম্পাসে অনেক গুণী চিকিৎসক, এডমিনিস্ট্রেটর ও চিকিৎসক নেতা তৈরি হলেও আমাদের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ক্যাম্পাসের চিকিৎসকদের অবদান অনেক বেশি যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং উনাকে ধারণ করে একটি ছাত্রাবাসসহ মোট আটটি হল রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমানে আন্ডারগ্রাজুয়েটের পাশাপাশি পোস্ট গ্রাজুয়েশনের এমফিল, রেসিডেন্সি ও এফসিপিএস প্রোগ্রামে সফলতার সাথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই প্রাচীন বিদ্যাপীঠ।
প্রতিবছর ২২০ জন নবীন স্টুডেন্টসহ দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নবীণ ও প্রবীণ স্টুডেন্ট- চিকিৎসক ২২ অক্টোবরকে সিওমেক ডে হিসেবে পালন করে থাকে, যেন হটাৎ করে ফিরে যায় তাদের সোনালী অতীতে, যেখানে প্রতিটি সিওমেকিয়ানের যৌবনের তেজোদ্দীপ্ত পদচারণায় মুখরিত হতো প্রিয় প্রাঙ্গণ।
সিওমেক ডে সকল আন্ডারগ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতা
তথ্য উপাও সংগ্রহ ও সরবরাহে সহযোগিতা করেছেন প্রফে. শিব্বির আহমেদ স্যার এবং সালেহ আহমেদ জুয়েল (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)।
Discussion about this post