আব্দুর রাজ্জাক
এই যুদ্ধে আমেরিকার কিছু ক্ষতি হচ্ছে না। আটলান্টিকের অপর প্রান্তে বসে দেশটি শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, তারা অস্ত্র ঠিকই বিক্রি করে যাচ্ছে আর দিনে দিনে ঋণের ফাঁদে ফেলে ইউক্রেনকে কিনে নিচ্ছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে রাশিয়া বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া অভিযোগ করে আসছিল যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে দোনবাস অঞ্চল গঠিত, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই রুশ ভাষাভাষী এবং রাশিয়ান বংশোদ্ভূত।
এখানে নিউ নাৎসিজম গড়ে ওঠার দরুন, এই অঞ্চলের মানুষদের ওপরে অত্যাচার চলেছিল। এই অঞ্চলে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, বহু মানুষকে আহত করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজকর্মে রুশ ভাষাভাষী মানুষদের অবজ্ঞা করা হয়েছে, তাদের ওপর অত্যাচার চলছিল নির্মমভাবে—এটাই ছিল রাশিয়ার অভিযোগ। এই অঞ্চলের মানুষ ২০১৪ সাল থেকেই স্বশাসন দাবি করে আসছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে আরও অন্যায়-অত্যাচার বেড়ে যায়। এখানকার মানুষ আসলেই ইউক্রেন সরকারের অধীনে থাকতে চাইছিল না, যার পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার মানুষ বিদ্রোহ করছিল। ইউক্রেনীয় সরকারের মদদে আজভ বাহিনী ও নিউ নাৎসি বাহিনী গঠিত হয়। এরা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে রাশিয়া বিশেষ অপারেশন শুরু করেছে, অর্থাৎ যুদ্ধ আরম্ভ করেছে।
সমানতালে যুদ্ধ চলছিল, রাশিয়া একপর্যায়ে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দখল করে নিয়ে সেখানে গণভোট করে—এ চারটি অঞ্চল দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপারোঝিয়া ও খেরসনের শতকরা ৯৬ ভাগ মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী স্থলপথে রাশিয়ার ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে বুচা ও ইজুমাও দুটি শহর দখল করে নেয়। ইউক্রেনীয় বাহিনী খেরসন অঞ্চলেও সামনে অগ্রসর হতে থাকে। ঝাপারোঝিয়া অঞ্চল রাশিয়া দখল করে নিয়েছিল পারমাণবিক পাওয়ার স্টেশনসহ, সেটার দিকেও ইউক্রেনীয় বাহিনী অগ্রসর হচ্ছিল, এ সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রচার করতে থাকে যে রাশিয়া যুদ্ধে একপ্রকার হেরে গেছে, রাশিয়ার দখলকৃত চারটি অঞ্চল ইউক্রেনীয় বাহিনী খুব শিগগির দখলে নিতে পারবে। যদিও এই অঞ্চলে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার ৯৬ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে চেয়েছে।
এ অবস্থায় ২০১৪ সালে যে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেই ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার ভূখণ্ডের যোগাযোগের যে সেতু, সেই সেতুকে ধ্বংস করার জন্য ইউক্রেনীয় বাহিনী গোপন তৎপরতার মাধ্যমে হামলা করে, ফলে সেতুর একটা স্প্যান ধ্বংস হয়, অর্ধেক অংশে যান চলাচল ব্যাহত হয়। ইউক্রেনীয় বাহিনী, ইউক্রেনীয় সরকার, পশ্চিমা দেশগুলো ও পশ্চিমা মিডিয়া রাশিয়ার ব্যর্থতা ও রাশিয়ার যুদ্ধে পরাজয় হয়েছে বলে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে।
সে সময়ই ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর জন্য সের্গেই সুরভিকিনকে নতুন কমান্ডার হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেন। রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নতুন জেনারেল নিয়োগ পাওয়ার পরে মিসাইল আক্রমণ শুরু করে, কাস্পিয়ান সাগরের ৯০০ মাইল দূর থেকে কিয়েভে আক্রমণ করে, কৃষ্ণসাগর থেকেও একই পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে রাতারাতি যুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। ইউক্রেনের বিদ্যুৎব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, যোগাযোগব্যবস্থা, রেল যোগাযোগব্যবস্থাসহ সার্বক্ষণিক সাইরেন বাজছে। পানি নেই, আলো নেই—এ অবস্থায় আছে ইউক্রেনের শত শত শহর ও গ্রাম। কথাগুলো বলার অর্থ, ন্যাটোসহ পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে যুদ্ধ দীর্ঘ করার জন্য মদদ দিতে থাকে। পুতিন বারবার আলোচনায় বসতে চাইছেন, কিন্তু ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমাদের কথায় ভর করে কোনো আলোচনায় বসতে চাইছেন না।
শীত আসন্ন। পশ্চিম ইউরোপ ও ইউক্রেন রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এই শীতে যদি রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, পশ্চিমারা যে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পশ্চিম ইউরোপের শিল্পকারখানা, তাদের জীবনযাপন, অর্থাৎ জ্বালানি-প্রক্রিয়ার বেশির ভাগই রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভর করে। যদি তাই হবে, তবে পশ্চিমাদের তো উচিত ছিল, ১৯৯২ সালের পর থেকেই ন্যাটোকে পূর্ব দিকে অগ্রসর না করা। ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ন্যাটোকে নিউট্রালাইজড করে রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, কেননা পশ্চিমাদের উন্নয়ন নির্ভর করে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর, এটা এখন প্রমাণিত।
পশ্চিমারা বুঝতে একটু ভুল করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অবস্থা অনেক পশ্চাৎপদ ছিল, তারপরও তারা হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে স্বমহিমায় তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন, অর্থাৎ রাশিয়া নিজের অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুকে জানান দিয়েছিল।
এক মাস আগেও কেউ ধারণা করতে পারেনি, গোটা ইউক্রেন অন্ধকারে নিপতিত হবে, সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা ও ইন্টারনেট সেবা পর্যুদস্ত হবে। তাই এখন আমরা যারা স্বস্তিতে আছি, এই স্বস্তির কোনো কারণ নেই, যদি রাশিয়ার ওপরে পশ্চিমাদের ক্রমাগত চাপ বাড়তে থাকে, তাহলে সামনের এক মাসের মধ্যে যদি নিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হয় ইউক্রেনের কোনো কোনো শহরে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এখানে একটি জিনিস লক্ষণীয়, এই যুদ্ধে আমেরিকার কিছু ক্ষতি হচ্ছে না। আটলান্টিকের অপর প্রান্তে বসে দেশটি শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করছে,তারা অস্ত্র ঠিকই বিক্রি করে যাচ্ছে আর দিনে দিনে ঋণের ফাঁদে ফেলে ইউক্রেনকে কিনে নিচ্ছে। ইউরোপকে জ্বালানি-সংকটে ফেলে অর্থনীতি দুর্বল করছে এবং আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়েছেন অপরিণামদর্শী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
এখানে আবার চলছে তথ্য-সন্ত্রাসের খেলা। পশ্চিমা মিডিয়া ঢালাওভাবে কিছু কিছু সংবাদ বিকৃতি করে প্রকাশ করছে, ১০ অক্টোবর মিসাইল হামলা চালানোর সময় একটি খেলার মাঠের সামনের ভবন ধ্বংস হয়েছিল। এখানে কিয়েভ দাবি করেছে, শিশুদের খেলার মাঠ। রাশিয়া বলছে, এখানে পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা অবস্থান করে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
কিয়েভ থেকে বলা হয়েছে, ঝাপারোঝিয়া অঞ্চলে দুটি গণকবর পাওয়া গেছে, এখানে রুশ সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধ করেছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কোনো বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামলা করে না। এখানকার যে গণকবর এসব ভুয়া, রুশ ভাষাভাষী লোকদের মেরে ইউক্রেনীয় বাহিনী এ নাটক মঞ্চস্থ করছে।
আমরা এ দেশে বসে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের যে খবর পাই, সেটা যে সর্বাংশে সত্য নয়, এর প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমানে ইউক্রেনের ব্ল্যাকআউট ও পর্যুদস্ত অবস্থা দেখে। ইউক্রেন পশ্চিমাদের সহায়তায় অনেক পরিকল্পনা করে রাশিয়া ও ক্রিমিয়ার মধ্যে সেতুর যে সামান্য ক্ষতি করল, এর ফলে ইউক্রেনের এই মহাবিপর্যয়।
আমরা শান্তিকামী মানুষ। এ অবস্থায় কোনোক্রমেই যুদ্ধ চাই না। আমেরিকাসহ পশ্চিম ইউরোপের উচিত, ইউক্রেন সরকারকে রাশিয়ার সঙ্গে বসে একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া। হতে পারে কারও মধ্যস্থতায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুরস্কের মাধ্যমে।সারা বিশ্বের মানুষের একযোগে সোচ্চার কণ্ঠে এখনই বলা উচিত, কোনো যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, আমরা এ ধরাকে রক্ষা করতে চাই।
Discussion about this post