মন্টি বৈষ্ণব
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির এই সময়ে আমাদের জীবনে এসেছে যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতি এনে দিয়েছে ব্যক্তিক যোগাযোগের এক নতুন যুগ। এ হলো সুখবর। এই ভালো খবরের পাশাপাশি রয়েছে মন্দ খবরও।
সাইবার জগতের বড় সমস্যার নাম ‘সাইবার বুলিং’। সাইবার জগতে বিভিন্নভাবে মানুষকে হয়রানি করার নামই সাইবার বুলিং। পুরুষের তুলনায় নারীরা এ পরিস্থিতির শিকার হন বেশি। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে হরহামেশাই নারীরা এর শিকার হচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে যাদের টার্গেট করা হয়, তাদের ভয় দেখানো, রাগিয়ে দেওয়া বা বিব্রত করার জন্য বারবার এ ধরনের আচরণ করা হয়।
দুটি গল্প
নারী উদ্যোক্তা টুম্পা (ছদ্মনাম)। মেয়েদের পোশাক ও আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে তাঁর অনলাইন উদ্যোগ। ব্যবসার প্রয়োজনে তাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজে ছবি ও মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর পেজের ইনবক্সে আসতে থাকে অতি নোংরা মেসেজ। ক্রেতা সেজে প্রথমে কথা শুরু করে ইনবক্সের অন্য প্রান্তে থাকা মানুষেরা। তারপর শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত আলাপ।
লায়লা (ছদ্মনাম) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ইনবক্সে হয়রানির তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্পও তিনি শুনিয়েছেন আমাদের। লায়লা জানান, একদিন হঠাৎ তাঁর এক বান্ধবী তাঁকে জানান,
তাঁর নামে নতুন একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। সে আইডি থেকে লায়লার পরিচিতজনদের কাছে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠানো হচ্ছে। এরপর হঠাৎ করেই লায়লার ইনবক্সে আপত্তিকর এসএমএস আসতে শুরু করে। পাশাপাশি শুরু হলো হুমকি। একপর্যায়ে লায়লা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ করে দিতে বাধ্য হলেন।
এমন অভিজ্ঞতা শুধু টুম্পা বা লায়লার ক্ষেত্রে হচ্ছে, তা নয়। প্রায় সব নারীকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়।
পরিসংখ্যান
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন) সাইবার বুলিং বিষয়ে তাদের আগস্ট (২০২২) মাসের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীর হার ৫০ দশমিক ১৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুরুষ ৪৩ দশমিক ২২ ও নারী ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তবে নারী অভিযোগকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা শতকরা ৮ জন বা ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। নারীর সংখ্যা শতকরা ৬ জন বা ৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এদিকে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’-এর পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত ২৭ হাজার ৭১৩ সেবাপ্রত্যাশীর মধ্যে ২১ হাজার ৫৯ জন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯৩৮ জন পরে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রদানে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। মোট ১৩ হাজার ৪২৫ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বদলে যাওয়া জীবন সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার হওয়া নারীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের বদল আসে। এই বদলের সবই প্রায় নেতিবাচক।
মোটা দাগে নারীদের মধ্যে যে বদলগুলো তৈরি হয়,
সেগুলোর মধ্যে আছে:
১. নিরাপত্তার অভাব বোধ।
২. বৈবাহিক জীবনে অশান্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে সংসার ভেঙে যাওয়া।
৩. পারিবারিক বন্ধন শিথিল বা ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
৪. মানসিক চাপ ও অস্থিরতা তৈরি।
আত্মহত্যার প্রবণতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহত্যা।
উত্তরণের উপায়
সার্বিকভাবে চিন্তা করলে, সাইবার বুলিং থেকে উত্তরণের উপায় অনেকটা কঠিন। যারা অপরাধপ্রবণ, তারা বিভিন্নভাবেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের ক্ষতি করে।
আমরা হয়তো জানিই না যে আমাদের আশপাশে থাকা মানুষেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে অন্য কাউকে বুলিং করছে।
সচেতনতা
এসব ক্ষেত্রে বড় সমাধান হলো সচেতনতা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় যুক্ত হবেন, সে বিষয়ে সব ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। অনলাইনে নেতিবাচক আচরণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আশপাশের মানুষকে বোঝাতে হবে এবং এগুলো নিয়ে বড় বড় ক্যাম্পেইন করতে হবে।
আইনের প্রয়োগ
সচেতনতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়া জরুরি। নারী-পুরুষ উভয়েরই এ বিষয়ে এগিয়ে আসা দরকার।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ জানান, সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের হেনস্তা করা আইনত অপরাধ। ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কোনো মাধ্যমে কারও নামে মানহানিকর বা অপমানজনক কিছু লেখা বা প্রকাশ করা বা মন্তব্য করা যেমন অপরাধ, তেমনি নিতান্ত বিরক্ত করা, সেটাও অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এ ধরনের কাজ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমে তিন বছর জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
আর একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তির মাত্রা বাড়বে। এ ছাড়া টেলিফোনে বিরক্ত করলে তা টেলিযোগাযোগ আইনের ৭০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
Discussion about this post