জয়নাল আবেদীন
প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের প্রায় ৩২ লাখ ৩১ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন দেওয়া হয় প্রোটিনসমৃদ্ধ বিস্কুট। করোনাভাইরাসের জেরে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বদ্ধ ঘরে পড়ে আছে কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি প্যাকেট বিস্কুট। স্কুল ফিডিং কর্মসূচির এই বিস্কুট মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্কুলে গরিব শিক্ষার্থীদের বিস্কুটগুলো ইঁদুরের পেটে যাওয়ার খবর মিলেছে।
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তালিকা করতে গত রোববার খোলা হয় রাজধানীর জুরাইন আদর্শ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অফিস খুলতেই শিক্ষকরা দেখেন, ছিন্নভিন্ন পড়ে আছে বিস্কুটের প্যাকেটগুলো। দীর্ঘ বন্ধের সুযোগে গরিব শিক্ষার্থীদের এই বিস্কুট ঠুকরে খেয়েছে ইঁদুরের দল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্যাকেটের অধিকাংশই ইঁদুরের পেটে গেছে এবং নষ্ট হয়েছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাকিলা নাসরিন সমকালকে বলেন, ‘আগে থেকেই স্কুলে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি। বন্ধের সময় অফিস কক্ষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্যাকেট বিস্কুট ছিল। এক মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার সুযোগে অধিকাংশ বিস্কুট ইঁদুরের পেটে গেছে। নষ্টও হয়েছে অনেকগুলো। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই অতিদরিদ্র এবং প্রতিবন্ধী। প্রায় পাঁচশ’ শিক্ষার্থী অপুষ্টিতে ভুগছে।’
শুধু এই বিদ্যালয় নয়, দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে এ ধরনের তথ্য আসছে। দারিদ্র্যপীড়িত ১০৪টি উপজেলায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় এক প্যাকেট করে বিস্কুট দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এ বিস্কুটে আছে গমের ময়দা, চিনি, উদ্ভিদ ফ্যাট বা ভেজিটেবল ফ্যাট, সয়া ময়দা। এ ছাড়া আছে প্রয়োজনীয় আয়োডিনযুক্ত লবণ, জিঙ্ক, লৌহ, বেকিং সোডা এবং ১৩ রকমের ভিটামিন।
প্রকল্প সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, উপকারভোগী সবগুলো বিদ্যালয়ে কয়েকদিনের বিস্কুট আগাম মজুদ করে রাখা হয়। গড়ে ১০ দিন করে হিসাব করলেও এ মুহূর্তে কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি প্যাকেট বিস্কুট মজুদ রয়েছে বিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও বিস্কুটগুলো নিয়ে কেউ সেভাবে চিন্তা করেনি। বিভিন্ন এলাকায় ইঁদুরের উপদ্রব রয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ কক্ষে ইঁদুরসহ পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। ফলে বিপুল পরিমাণ বিস্কুট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।
শিক্ষকরা বলছেন, গরিব শিক্ষার্থীদের বিস্কুটগুলো এভাবে নষ্ট করতে দেওয়া যায় না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নির্দেশনা দিলে সংশ্নিষ্ট এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে এগুলো বিতরণ করা সম্ভব। সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অতিদরিদ্র শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের ঘরে ত্রাণসামগ্রী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে উদ্যোগ নিলে বিস্কুটগুলোও বিতরণ করা সম্ভব। অথবা বিকল্প উপায়ে বিস্কুটগুলো রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
পটুয়াখালীর গলাচিপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাসেম সমকালকে জানান, ওই বিদ্যালয়ে সাত শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র। দীর্ঘ এক মাসের বেশি স্কুল বন্ধ। ঈদের আগে খোলার সম্ভাবনা নেই। ফলে দীর্ঘদিন ওভাবে পড়ে থাকলে বিস্কুটগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মানও ঠিক থাকবে না। ফলে এখনই এগুলো শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। কারণ, শিক্ষার্থীদের সবার বাড়ি আশপাশেই।
তিনি জানান, হতদরিদ্র ও এতিম শিক্ষার্থীদের তালিকা হচ্ছে। তাদের পরিবারে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির বিস্কুটগুলো বিতরণ করে দিলে ভালো হয়। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর উদ্যোগ নিতে পারে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার চর পাত্রখাতা উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মজুদ রয়েছে কমপক্ষে ১২ হাজার প্যাকেট বিস্কুট। ওই বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক সমকালকে বলেন, এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চারশ’। চর এলাকা হওয়ায় প্রায় সব শিক্ষার্থীই হতদরিদ্র। লকডাউনের এই সময়ে তারা এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের সংকটে ভুগছে। এই সময়ে তাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার বেশি প্রয়োজন। এ ছাড়া বেশিদিন প্যাকেটবন্দি থাকলে বিস্কুটের মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এগুলো অচিরেই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া উচিত।
একই উপজেলার মন্তোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, ওই বিদ্যালয়ে মজুদ রয়েছে দেড় হাজার প্যাকেট। কয়েক দিন আগে একটি বিশেষ প্রয়োজনে স্কুল খোলার পর দেখা যায় কিছু বিস্কুট নরম হয়ে গেছে। এভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে বিস্কুটগুলো নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও এ প্রকল্পের পরিচালক মো রুহুল আমিন খানের মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, সংশোধিত আকারে ২০১০ সাল থেকে চলছে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি। লক্ষ্য ছিল ঝরেপড়া রোধ, শিক্ষার হার ও গুণগত মান ঠিক রাখা এবং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করা। দেশের ১০৪টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলার ১৫ হাজার ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ কর্মসূচি চলছে। প্রকল্পটি সফলতার মুখ দেখেছে বলেও বিভিন্ন সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করে আসছে। সরকারি অর্থায়নে ৯৩টি উপজেলায় ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অর্থায়নে ১১টি উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সৌজন্যে – সমকাল
Discussion about this post