ফাতিহুল কাদির সম্রাট
বিষয়টি বোঝার জন্য ঘটনা বলা প্রয়োজন। জেলার সবচেয়ে বড় কলেজ। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে। করোনার প্রভাব কাটিয়ে তারা ক্লাসে এসেছে। অল্পসংখ্যক বাদে শিক্ষাথী প্রায় সবাই এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া। শুরু থেকেই এ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে শিক্ষকদের গলদঘর্ম অবস্থা। পড়ালেখায় তাদের মনোসংযোগে ঘাটতি শিক্ষকদের কাছে ধরা পড়ে দ্রুতই। তাদের আচরণে সামাজিকীকরণ ও সমাজমনস্কতার অভাব লক্ষ্যযোগ্য। বিশেষ করে ছেলেদের চেহারায় অপুষ্টি, অনিদ্রা, অন্যমনস্কতা ও ক্লান্তির ছাপ। ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তাদের অনেকের মন যেন পড়ে থাকে ক্লাসের বাইরে; অন্য কোনো ভুবনে। কৌতূহলশূন্য চেহারায় ভাবলেশহীনতা ও চিন্তার ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ততা অনেকের বেলায় স্পষ্ট। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত নয়। প্রতিক্রিয়া জানালেও আত্মবিশ্বাসের অভাব প্রকট।
এ ঘটনার আলোকে শিক্ষকদের অভিযোগ ও পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে কারণ অনুসন্ধান ও করণীয় নির্ধারণে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডাকা হলো। সভায় ছাত্রছাত্রীদের আচরণ ও একাডেমিক অর্জন হতাশাজনক অবস্থার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় স্ক্রিনে আসক্তিকে। কম্পিউটার, ট্যাব ও স্মার্টফোন প্রভৃতির মাধ্যমে নেট-দুনিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের এ আসক্তি মাদকের নেশার চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনের পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করা হয়। কড়া নজরদারি সত্ত্বেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর কাছে পাওয়া যায় স্মার্টফোন। কিছু মোবাইল ফোন আবার উচ্চমূল্যের। অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে থাকা মোবাইল ফোন তার অভিভাবকের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফল শিক্ষকরা যেমন ধারণা করেছিলেন, হলোও তেমনটাই। রীতিমতো বিপর্যয়কর। দুই-তৃতীয়াংশ অকৃতকার্য। উদ্বিগ্ন কলেজ প্রশাসন বিহিত সন্ধানে অভিভাবকদের ডাকলেন মতবিনিময়ের জন্য। শিক্ষার্থীদের হতাশাজনক ফলের কথা জানানো হলো তাঁদের। অভিভাবকদের অধিকাংশই জানালেন, তাঁদের কাছে নিজেদের সন্তানকে অচেনা মনে হয় অনেক সময়। বাচ্চাদের আচার-আচরণ এবং জীবনযাপন পদ্ধতি কীভাবে যে পাল্টে গেছে, তাঁরা বুঝতেও পারেননি। সন্তানদের মুখের ভাষা পর্যন্ত পাল্টে গেছে।
উল্লিখিত বাস্তবতায় বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্রছাত্রীদের স্ক্রিনে আসক্তি থেকে মুক্ত করার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটিভেশনাল কাজ করে যাচ্ছি। স্কুল পর্যায়ে নতুন যে কারিকুলাম পাইলটিং করা হচ্ছে, তার আওতাধীন ২০২৩ সালের জন্য মুদ্রিত ষষ্ঠ শ্রেণির কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক দেখার সুযোগ হয়েছে সম্প্রতি। বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখার সময় লক্ষ্য করি, বইয়ের কিছু পাতায় কিউআর বা কুইক রেসপন্স কোড মুদ্রিত। কোডগুলো স্ক্যান করে কোডের আড়ালে থাকা বিষয়বস্তু শোনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বইয়ে। যেমন- ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ নাটকের সঙ্গে কিউআর কোড মুদ্রিত। সেটি মোবাইল ফোনে স্ক্যান করলে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ গানটি বাজে।
শিশুদের বইয়ে কিউআর কোড যুক্ত করা সমীচীন মনে করি না। এতে উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, শিক্ষককেন্দ্রিক সনাতনী টিচিং মেথড পরিহার করে তুলনামূলক কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক মেথডে আসার অংশ হিসেবে এই কিউআর কোড ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রায়োগিক অনুশীলনের সুযোগ লাভ করবে এবং এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং মেথড বা অ্যাপ্রোচের প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাবে। এসব মেথড বা অ্যাপ্রোচ উন্নত বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। তাঁদের এ বক্তব্যে যুক্তি আছে বটে। কিন্তু এটিও মনে রাখা দরকার, একটি দেশের কারিকুলাম তার আর্থসামাজিক বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পনা করা উচিত। সারাবিশ্বে যেখানে শিশুদের স্মার্টফোন ও নেট-দুনিয়া তথা স্ক্রিনে আসক্তির কুফল নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কীভাবে তাদের এই আসক্তি থেকে মুক্ত রাখা যায় সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে যেখানে; সেখানে আমাদের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা শিশুদের স্মার্টফোনমুখী করে তুলছেন না তো! প্রযুক্তির সুফলের সঙ্গে সঙ্গে কুফলের দিকটাকেও বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। কিউআর কোড স্ক্যান করে শোনার বদলে ছাত্রছাত্রীরা গানটি যদি দলীয়ভাবে গেয়ে ড্রিল বা অনুশীলন করত তাহলে এক্সপেরিয়েন্সিয়াল ও পার্টিসিপেটরি দুটি অ্যাপ্রোচেরই প্রয়োগ নিশ্চিত হতো। এই কিউআর কোড সংযোজনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা এখন স্মার্টফোনকে পাঠ্যবইয়ের অংশ মনে করবে এবং অভিভাবকদের বাধ্য করবে তাদের হাতে স্মার্টফোন দিতে, যা খারাপ ফল বয়ে আনবে। সিদ্ধান্তটি ভেবে দেখা দরকার।
ফাতিহুল কাদির সম্রাট: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ
Discussion about this post