ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
বাঙালির দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের উত্তরাধিকার নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে প্রেরণা দিয়েছে। লড়াইয়ের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা বাঙালিকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে বাঙালি স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি। আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার রক্ষায় বাঙালির বীর সন্তানেরা বারবার যুদ্ধে গেছে। জয়ী হয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য। ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছে। ব্রিটিশদের হটিয়ে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বাঙালির সন্তানেরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর বাঙালি বুঝতে পারে এই জাতিকে ফের স্বাধিকারের জন্য রক্ত দিতে হবে। বিশেষত যখন বাঙালির মায়ের ভাষার দাবি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে উপেক্ষিত হতে থাকে। বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে বায়ান্নর রৌদ্রময় পথে রক্ত দিতে হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ বীর সন্তানদের। বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালি পাকিস্তানিদের কঠোর বার্তা দেয়। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও মানচিত্রে বিস্তর ফারাক রেখে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশ এক থাকতে পারে না তা প্রকাশ্য আলোচনায় জোরালোভাবে উঠে আসে মূলত বায়ান্নর পরেই।
২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন পূর্ব বাংলার মানুষের মনে ঘৃণা ও উৎকণ্ঠার জন্ম দেয়। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন হওয়ার ঘটনা তাই অনিবার্য। শুধু ভৌগোলিক দূরত্ব নয় পাকিস্তান রাষ্ট্র, শাসক ও দেশটির জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের গণমানুষের ব্যবধান ছিল অনেক। পাকিস্তানি শাসকদের সৃষ্টি করা আর্থিক বৈষম্য, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে। পাকিস্তানি শাসকরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে বাংলার মানুষের ম্যানডেটকেও তারা মানতে রাজি ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়কে তারা তোয়াক্কা না করায় তাদের পতনের গতি ত্বরান্বিত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে স্বাধীনতা। বাঙালির শৌর্য-বীর্যে পরাজয় ঘটে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। ১৬ ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার। এখন এদিনটি বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে দেশ শাসনের ভার ন্যস্ত করে পূর্ব বাংলার মানুষ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি গোষ্ঠী বাঙালিদের হাতে শাসনভার ন্যস্ত করেনি। ঘটনার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হলে পাকিস্তানি গোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে। আন্দোলন অব্যাহত রাখে বাংলার মানুষ। বাঙালি বুঝতে পারে স্বাধীনতা ছাড়া এই যাত্রায় আর ভিন্ন কোনও পথ নেই। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণে স্বাধীনতার নির্দেশনা স্পষ্ট ছিল। ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপরে উগরে দেয় তার সমস্ত ক্রোধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, কালরাত্রিতে বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন শুরু করে। শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধে বাংলার মাটিকে শত্রুমুক্ত করে বীর বাঙালি। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
বাঙালি সবচেয়ে ভাগ্যবান জাতি। কারণ, বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মতো একজন হিমালয়সম নেতাকে পেয়েছে। যে নেতা এই জাতিকে বহুকালের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি এনে দিয়েছেন। আবার বাঙালি সবচেয়ে দুর্ভাগা জাতি, যে জাতি এমন মহান নেতাকে প্রায় সপরিবারে ঘৃণ্য পন্থায় হত্যা করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ তার পথ হারিয়ে ফেলে। দুই দশকেরও বেশি সময় পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের নেতৃত্বভার লাভ করেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণকে ত্বরান্বিত করছেন। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে দিয়েছে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াবার সাহস। নিম্ন আয়ের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ এ সরকারের অন্যতম বৃহৎ অর্জন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পগুলোর কিছু চালু হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের এসব উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের গুণে অর্জিত হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পৃথিবীর সামনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নানা সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম বাড়ানো। এ লক্ষ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি করে বিশেষায়িত গবেষণা কোষ স্থাপন। জ্ঞান ও দক্ষতায় শিল্পক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আন্তযোগাযোগ ও সমন্বয় বৃদ্ধি করার কর্মকৌশল নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও এফবিসিসিআই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। প্রযুক্তিগত গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয় করতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে উদ্বুদ্ধকরণ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা ও ও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক সিলেবাসে প্রয়োজনে সংশোধনী আনয়ন।
বিগত দশ বছরে আইসিটি খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকালে বাংলাদেশ হবে শিক্ষা-গবেষণা ও প্রযুক্তির ডেস্টিনেশন। ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিতে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে আমাদের আইসিটি সেক্টরের মেধাবী তরুণরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইটেক পার্কগুলোতে আইসিটি মন্ত্রণালয় নানাভাবে যুক্ত রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে দক্ষ আইসিটি টেকনোলজিস্ট তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারা দেশের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারেন। এই সামগ্রিক কার্যক্রমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবদান রাখবে।বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস-এর মতো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্লু-ইকোনমিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়- এ ধরনের শব্দগুচ্ছ বাঙালির কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যে জাতি রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, যে জাতির রয়েছে দীর্ঘকাল লড়াইয়ের ইতিহাস, সে জাতি কখনও পরাজয় মানে না, যেকোনও যুদ্ধে সে জাতি জয়ী হয়। চলতি বছরের জুন মাসেই উদ্বোধন করা হয়েছে স্বপ্নের সেতু পদ্মার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাঙালি এগিয়ে চলেছে লক্ষ্যপানে। বাঙালি যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে দৃঢ়তার সঙ্গে। বাঙালি ধন্য, কারণ এই জাতি বিজয় দেখেছে। বাঙালি ধন্য, কারণ এই জাতি শেখ মুজিবুরের মতো পিতা এবং শেখ হাসিনার মতো কন্যা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু এনে দিয়েছে স্বাধীন দেশ, পতাকা, মানচিত্র। শেখ হাসিনা বাঙালি জাতিকে দিয়েছে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, ডিজিটাল বাংলাদেশ ও অর্থনৈতিক বিজয়।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ধাপে ধাপে সম্পন্ন করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য পুত্র ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক অবৈতনিক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নিরলস পরিশ্রমের ফলে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ঋণগ্রস্ত দেশ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বাঙালি জাতি আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে। দেশে এখন আইটি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি বিরাজমান। আছে সাবমেরিন ক্যাবলের সুবিধা, সরকারি সেবাগুলো ডিজিটালাইজড, চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার দৃশ্যমান, ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, আইটি ও হাইটেক পার্ক নির্মাণ, অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা, গ্রাম হচ্ছে শহর। ক্যাশলেস সোসাইটির কাজ প্রক্রিয়াধীন। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পর ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। যার ঘোষণা ইতোমধ্যে এসেছে। দেশে এমন উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার কারণে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে স্বয়ংসম্পন্ন দেশে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বে ফসল আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বাঙালি বীরের জাতি। সব বাধা পেরিয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নব উদ্যমে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দ হোক আমাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা।
লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য- বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল); সহ-সভাপতি- আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন; সভাপতি- এডুকেশন, রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি)।
Discussion about this post