ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
আমরা প্রায়শই একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হই যে, ‘আমরা কিভাবে আমাদের জীবন-যাপন করছি বা কোন নীতি এবং নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা আমরা পরিচালিত ও অনুপ্রাণিত হচ্ছি? মূল্যবোধ চর্চায় যে কথাটি সর্বোতভাবেই প্রণিধানযোগ্য তা হলো জীবনবোধ ও জীবনমানে সত্য, সঠিক ও সুন্দরের দৃশ্যমান প্রতিফলন। জীবনের প্রতিটি স্তরে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকশিত ধারা প্রতিটি ব্যক্তিকে করে আদর্শিকভাবে সমুন্নত ও মানসিকভাবে আলোকিত।
মূল্যবোধের চিরায়ত এ অনুশীলন শিখতে হয় স্কুল আঙ্গিনা থেকে। শিক্ষকদের আদর্শিক চেতনা, জাগ্রত বিবেক ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াস শিক্ষার্থীদের মাঝে মূল্যবোধ শিক্ষার বীজ বপন করতে পারেন। স্কুলের বিধি-নিষেধের আবর্তে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঠিক পর্যবেক্ষণে মূল্যবোধের সুশিক্ষা অর্জন করতে পারে।
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রত্যাশা করে যে, তাদের সন্তান ভালো মানুষ
হিসেবে বেড়ে উঠুক এবং নৈতিকতার চর্চায় সেরা সন্তান হিসেবে সমাদৃত হোক। প্রত্যেকেই মনে করে্ যে
শিক্ষা তারা পরিবার থেকে দিতে পারেনি, সে শিক্ষা তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাবে। শিক্ষকদের উপরে
তাদের দারুণ বিশ্বাস দৃঢ় আস্থা। একজন প্রিন্সিপাল হিসেবে আমিও এটি বিশ্বাস করি। কারণ শিক্ষক হলেন
মানুষ গড়ার মহান স্থপতি। সমাজের শিশু শিক্ষার্থীরা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম
বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর এর দায় শিক্ষকদেরকেই নিতে হবে। শেখার একটি ব্যাপক সময় তারা স্কুলে থাকে।
প্রতিদিন প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টা তারা শিক্ষকদের সাথে কাটিয়ে থাকে। আর এটি হলো মূল্যবোধ শেখার
অন্যতম সময়।
অতএব, বিশ্বে সফল হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের যে মূল্যবোধ ও দক্ষতার প্রয়োজন হবে তা শেখানোর জন্য
শিক্ষকদের একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দায়িত্ব পালনের বিষয়টি আধুনিকতার ছোয়ায় খাপ খাওয়ানো বা একাডেমিক বিশ্বে নির্বিঘ্নে নেভিগেট করার ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; শিক্ষকদেরকেও মহান মূল্যবোধের মডেল হতে হবে।
শিক্ষার্থীদেরকে মানবিক মূল্যবোধ শেখাতে শিক্ষকদেরকে প্রধান কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। যেমন;
১। পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দিতে শেখানোঃ শিক্ষক যখন মূল্যবোধ এবং শিক্ষা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনাগুলি প্রয়োগ করতে ইচ্ছা করেন, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তারা যা চাচ্ছেন তার অনেক কিছুই যথাযথভাবে ঠিক নেই। কারণ পরিবার ভেদে শিক্ষার চর্চা ভিন্ন হতে পারে। স্কুলে সকল শিক্ষার্থী এক পরিবার থেকে আসে না, বরং তাদের সকলের পারিবারিক ঐতিহ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই আমাদের শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ প্রদান করার সময়, তাদের পরিবারের মূল্যবোধকে সম্মান করা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বুঝা যায় যে, মূল্যবোধের ধারণাটি সর্বোত্তমভাবে বিষয়ভিত্তিক এবং সেখানে মৌলিক মূল্যবোধ রয়েছে যা সমস্ত পরিবারই তাদের সন্তানদেরকে শেখাতে চান। শিক্ষক হিসাবে শ্রেণীকক্ষগুলিতে এই মূল্যবোধসমূহ নিয়মিত চর্চার মাধমে শক্তিশালী করা উচিত। শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচক এবং সম্মানজনক আচরণের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকগণ পারিবারিক মূল্যবোধগুলিকে মূল্যায়ন করবেন।
২। দয়া ও সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়াঃ শিক্ষকদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে নানাবিধ মিথস্ক্রিয়া করে তাদের মধ্যে দয়া, সহানুভূতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে কয়েকটি বেসিক মূল্যমানের প্রতি উৎসাহ জাগাতে হবে। এক,
শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র একে অপরের প্রতি নয়, বিদ্যালয়ের অন্যান্য সদস্যের প্রতিও দয়া দেখানোর জন্য
উৎসাহিত করতে হবে। দুই, শিক্ষকগন শিক্ষার্থীদের মাঝে একে অন্যের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল
হওয়ার যে শিক্ষা প্রদান করা হয় তা মূল্যায়ন করতে একটি ম্যাট্রিক্স বানানো উচিত। তিন, শিক্ষার্থীদেরকে
সদয় আচরণের জন্য পুরস্কৃত করার বিধান রাখা উচিত। চার, মাঝে মাঝে অভিভাবকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে
তাদের সন্তানদের দয়া প্রদর্শনের যে অগ্রগতি হয়েছে তা অবহিত করে তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।
পাঁচ, মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী এলাকাতে অবস্থিত গরীব ও অসহয়ায় মানুষদের ডেকে তাদেরকে
সাহায্য করার শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। দয়া দেখানোর একটি দৃষ্টান্ত এমন হতে পারে, শিক্ষার্থীরা যখন
খেলার মাঠে বা পিকনিকে যায়, তখন কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে তার প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রকাশের শিক্ষা বিদ্যালয় থেকেই দিতে হয়।
৩। সততা অনুশীলন করাঃ পরিবারের সাথে অবস্থানকালে অনেক সন্তান মিথ্যা কথা বলতে পারে, যা বাবা-মা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেনেও নিয়ে থাকেন। এটি সন্তানের প্রতি অতি আদরের কারণে হতে পারে, যদিও এমনটি করা ঠিক নয়, বরং পরিবারেও তাদেরকে সর্বদা সত্য বলা শেখাতে হবে। শিক্ষকগণ কখনোই বিদ্যালয়ে মিথ্যা চর্চার এহেন কাজ করেন না। শিক্ষার্থীদের মিথ্যা কথা ও কাজের চর্চার ব্যাপারে শিক্ষকদেরকে সর্বদা সজাগ থাকেন। কোনভাবেই তারা যেন অসদাচারণ বা অসততা অনুশীলন করতে না পারে সেদিকে কড়া নজর দিয়ে থাকেন। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে কাউন্সেলিং করে সততার দীক্ষা দিবেন। প্রয়োজনে স্কুলে সততার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে পুরস্কৃত করে মিথ্যা চর্চার প্রতি ঘৃণা ছড়াতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।
৪। ব্যক্তিত্ব উন্নয়নের শিক্ষা দেয়াঃ শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে অল্প বয়স থেকেই ব্যক্তিত্ব ও
আত্মমর্যাদাবোধ শিক্ষা দিতে হবে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববোধেই তার বংশের মর্যাদা রক্ষা পায়। শ্রেণিকক্ষে
বাচালতা, অপ্রাসংঙ্গিক কাজ করা, বাহুল্য ভাব নেয়া, সহপাঠীদের ডিস্টার্ব করা, কথা কাজের অমিল
প্রদর্শন করা ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিত্বহীন কাজ। এগুলি তাদেরকে আত্মমর্যাদাহীন করে
তোলে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকগন তাদেরকে মোটিভেশন দিয়ে আত্মমর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিত্বসুলভ আচরণের
শিক্ষা দিবেন।
৫। আচার-আচরণে বিনয় শেখানোঃ কথায় বলে, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। পরিবার থেকে এ শিক্ষা না পেলে স্কুলজীবনে তা শিখতে হবে। শিক্ষক স্কুলে শিক্ষার্থীদেরকে আচার-ব্যবহার, ভদ্রতা-নম্রতা, রীতি-নীতি,
কৃষ্টি-কালচার, বিনয়-সভ্যতা শেখাবেন। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শুদ্ধাচার চর্চা করাতে পারেন।
শ্রেণিকক্ষে আচরণবিধি একটি চার্ট বানিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করাতে পারেন। প্রয়োজনে, কোন শিক্ষার্থী
আচরণবিধি লংঘন করলে, তাদের জন্য শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে বা তাদের বাবা-মাকে
বিদ্যালয়ে ডেকে তাদের আচরণ সম্পর্কে অবহিত করা যেতে পারে।
৬। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা বিধানের শিক্ষাঃ শৃঙ্খলা সামাজিক মূল্যবোধের প্রধান একটি অংশ। শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃঙ্খলা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে। শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করে শিক্ষকগণ তাদেরকে তা চর্চার জন্য তাগিদ দিবেন। বিদ্যালয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। বিদ্যালয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভংগী, দায়িত্ববোধ, স্ব-শৃঙ্খলা, উম্মুক্ত মানসিকতা, ধৈর্য্য, আপস করার ইচ্ছা এবং বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ বিকাশের অন্যতম কৌশল।
৭। স্মার্ট যোগাযোগ দক্ষতা শেখানোঃ সামাজিক ও মানবিক গুনাবলী অর্জন করতে শিক্ষার্থীদেরকে স্মার্ট যোগাযোগ দক্ষতা শেখাতে হবে। কথা বলার স্টাইল, শোনার পর্যাপ্ত ধৈর্য্য, বক্তা ও শ্রোতার মাঝে
সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, বলা ও লেখার মধ্যে বিনয় ও শ্রদ্ধার উপস্থাপন, সম্মোধনে সম্মানবোধ,
কথা ও কাজের মধ্যে মিল রেখে প্রতিশ্রুতি রাখা এবং যে কারোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে
নিঃস্বার্থ মনোভাব প্রদর্শনসহ অন্যান্য সফট স্কিল উন্নত করার শিক্ষা শ্রেণিকক্ষেই শেখাতে হয়।
শিক্ষক ক্লাসে নিয়মিত কথোপকথন, বক্তৃতা প্রদান ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিষয়ভিত্তিক যুক্তিতর্ক
উপস্থাপনা শেখালে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৮। পরোপকারিতার চর্চা শেখানোঃ পরস্পরের প্রতি পরোপকারিতার চর্চা ক্লাসরুমে বা স্কুলে সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে মানবিক গুণাবলী শেখাতে। স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনেক দায়িত্ব আছে যেমন; স্কুলের সম্পদ নষ্ট না করা, কর্মচারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, স্কুল আঙ্গিনা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, অন্যের অধিকার নষ্ট না করা, কারোর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করা, সহপাঠী বা বন্ধুদের সাথে সদাচারণ করা, শুদ্ধাচার চর্চায় ব্রত হওয়া এবং উঁচু-নীচু, ধনী-দরিদ্র ও সাদা-কালো বর্ণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ সৃষ্টি না করা ইত্যাদি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার প্রশংসনীয় দিক। শিক্ষক এগুলো শিক্ষার্থীদেরকে শেখাবেন এবং সর্বদা পরোপকারী হওয়ার প্রতি নসিহত দিয়ে তাদেরকে বাস্তবজীবনে চর্চা করতে শেখাবেন।
৯। শিখনফলের বাস্তব প্রয়োগ শেখানোঃ শিক্ষক তার শ্রেণি কার্যক্রমের মাঝে পাঠ্যপুস্তকের যে বিষয়গুলি পাঠদান করে থাকেন সেগুলিকে জীবনমূখী বাস্তব জ্ঞানে রুপান্তরের চেষ্টা করবেন। পঠিত বিষয়ের শিখনফল শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে তারা তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করতে পারবে এবং সমাজের মানুষদেরকে তারা উপকার করতে পারবে। স্কুল আঙ্গিনা পরস্কারের চর্চা তারা তাদের বাসা-বাড়িতেও করতে পারবে, যা তাদের পরিবেশ রক্ষার কাজে অবদান রাখবে। টিফিন টাইমে শিক্ষক যদি হাত-ধোয়ার অভ্যাস শেখাতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীরা বাড়ি গিয়ে তা নিজেরা যেমন চর্চা করতে পারবেন তেমনি তাদের ছোট ভাইবোনদেরকেও শেখাতে পারবেন। এভাবে তাদের মধ্যে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ উজ্জীবিত
হবে।
অতএব, শিক্ষাঙ্গন হলো শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ বানানোর অন্যতম কারখানা। শিক্ষকগন তাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মগজের মধ্যে যদি মানবীয় গুনাবলী অর্জনের শিক্ষা ঢুকিয়ে দিতে পারেন, তাহলে তারা সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে একটি আদর্শ ও মর্যাদা সম্পন্ন জাতি ও দেশ বিনির্মান করতে পারবে। শিক্ষকগদের উল্লিখিত দশটি কৌশল সম্পর্কে নিজেরদেরকে যেমন সচেতন হতে হবে,তেমনি শিক্ষার্থীদের মাঝে তা চর্চার বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান দিতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে একটি মূল্যবোধ সম্পন্ন উন্নত মানুষ ও দেশ গড়ার আদর্শ কারিগর।
লেখক- ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান, প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক ।
Discussion about this post