ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাসান
আমি আমার দেশে যে ভাষায় কথা বলতে পারছি, সেটি আমার মাতৃভাষা। এভাষা আজ আমার একার ভাষা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই এ ভাষার মর্যাদা দিতে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপন করে থাকে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে ইউনেস্কো (UNESCO) এর ঘোষণার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ঢাকার সেগুনবাগিচায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষাসংক্রান্ত গবেষণা, ভাষা সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এটি ভাষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে যা বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় সমাসীন করতে অবদান রাখছে।
রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা মূলত একটি, সেটি বাংলাদেশ। এর বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রদেশ, আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা, ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রদেশিক ভাষা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে একমাত্র আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বাংলাকে স্বীকৃতির বিল পাস করে। এভাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা বেড়ে চলেছে অনন্য উচ্চতায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ৬৯০৯টি ভাষার মধ্যে এর অবস্থান পঞ্চম স্থানে। কেননা, জনসংখ্যা রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে বাঙালি জনসংখ্যা এখন প্রায় ২৯ কোটির কাছাকাছি।
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের ৪ মহাদেশের ৩০টি দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এ ছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষাতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। এক গবেষনায় দেখা গেছে,, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পরপরই বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। বিশ্বের ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্রিটেনে ছয়টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বৃটেনে ১২টি বাংলা সাপ্তাহিক প্রত্রিকা বের হয়। ‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে।
ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিশ শহর থেকে তিনটি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছয়টি অনলাইন টেলিভিশন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু রয়েছে। এছাড়া ডেনমার্ক সুইডেনসহ ইউরোপের আটটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে বাংলা ভাষার মূদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে উনিশ শতক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা নিয়ে গবেষণার কাজ চলছে। যুক্তরাজ্যে বতর্মানে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করছেন জেডি অ্যান্ডারসন, টি ডব্লিউ ক্লার্ক, জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানা রুথ টমসন প্রমুখ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ী বাংলা রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন কয়েক দশক ধরে।
যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন ও হার্ভার্ড উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফান্সো চাকোন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করেন নজরুল সাহিত্য নিয়ে। এ বিষয়ে তাঁর বইও প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ভাষা শেখানোর বাইরেও গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও লালন সাহকে নিয়েও। ক্লিনটন বি সিলি, র্যালফ নিকোলাস, ক্যারল সলোমন, ক্যারোলিন রাইট, হেনরি গ্লাসি প্রমুখ বিদেশি বাংলা গবেষকের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাচর্চার প্রসার ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতা নিয়ে ক্লিনটন বি সিলির গবেষণার সুনাম বিদ্যায়তনের বাইরেও ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে। তিনি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়েও কাজ করেছেন। একই রকম খ্যাতি পেয়েছে যুক্তরাজ্যের কবি ও গবেষক উইলিয়াম রাদিচের রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ।
কানাডার জোসেফ ও’কনেল এবং ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসনসহ বেশ কয়েকজন বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণা করছেন। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের বাংলা বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে।
জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাশাপাশি মার্টিন কেম্পশেন বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণা করেছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করেছেন চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার নিয়ে। তিনি প্রাচীনতম বাংলা কবিতা চর্যাপদ নিয়েও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন।
পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়াল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ অনুবাদ করছেন। বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষার পুরোনো বই ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সেসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন মৌলিক সাহিত্য। অতি সম্প্রতি ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার প্রক্রিয়া চলছে।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাচর্চার সূচনা করেছিলেন লেখক ও চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব ও শিবনারায়ণ রায়। তাঁদের প্রেরণায় মারিয়েন ম্যাডার্ন বাংলা গবেষণা ও অনুবাদে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশে যেসব এশীয় ভাষা শেখার জন্য গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলার অবস্থান তাতে তৃতীয়।
এশিয়ায় বিশেষভাবে বাংলার চর্চা হয় জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। তবে জাপান ও সাম্প্রতিক চীন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুও আজুমা রবীন্দ্র-অনুরাগ থেকে বাংলা ভাষাচর্চা শুরু করেছিলেন। জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেই শিরায়, কিওকো নিওয়া, উদিচা দম্পতিসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি গবেষক সেখানে কাজ করছেন। তিন বছর আগে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষা শেখানো। জাপানি শিক্ষার্থীরা সেখানে বাংলা ভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছেন। সেখানে পাঠদান করছেন কিওকো নিওয়া, কাজুহিরো ওয়াতানাবে ও মনজুরুল হক।
জাপানের কিয়োতো ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বতর্মানে বাংলা ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন হুজিয়ারা ও তোমিও মিজকামি। বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশের চাক ভাষা নিয়ে অভিধান রচনা করছেন তাঁরা। এ ছাড়া গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের হিদিকি মাকি বাংলা ও জাপানি ভাষার বাক্য গঠন নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করছেন। রেডিও এনএইচকেতেও বাংলা ভাষা শিক্ষাসহ নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে বাংলায় কাজুহিরো ওয়াতানাবের নেতৃত্বে।
সম্প্রতি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে নিয়মিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাস চালু হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে। চীন থেকে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু অনুবাদকর্ম। এ ছাড়া রবীন্দ্রসাহিত্য চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছেন চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের সাবেক ৩০ কর্মী।
উনিশ শতকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও পর্তুগালের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত। মূলত এশিয়াটিক সোসাইটির হাত ধরে সে গবেষণা পরে একটি কাঠামো পায়। এসব দেশের ঔপনিবেশিক পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারকদের হাতে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু হয়। ব্রিটিশ পণ্ডিত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন ১৮৯৪ থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে ২০ খণ্ডে আট হাজার পৃষ্ঠার লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া নামে বিখ্যাত সমীক্ষাগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
বিশ্বের প্রায় সকল দেশ থেকে পাঠকেরা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রসিদ্ধ বাংলা পত্রিকাসমুহের অনলাইন ভার্সন থেকে নিয়মিত সংবাদ পড়ে থাকেন। সেই অর্থে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বাংলাভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক টিভি চ্যানেলও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ সমাদৃত। বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, এনটিভি, এটিএন বাংলাসহ অসংখ্য চ্যানেল বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। করোনা প্যান্ডেমিক এর কারনে ফেঁচবুক, টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি প্লাটফরম ব্যবহার করে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বাংলা ভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অতএব উপরের আলোচনা থেকে একথাটি সুস্পষ্ট যে, বাংলা এখন শুধু বাংলাদেশের ভাষা নয়, বরং এটি এখন আন্তর্জাতিক ভাষা, যা প্রতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অধিভুক্ত সকল দেশে একযোগে উদযাপনের মধ্য দিয়ে এ ভাষার চর্চাকে আরো সমুন্নত করা হয়। এভাবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি পেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো সম্মৃদ্ধশালী হোক আমি এ প্রত্যাশা করছি।
Discussion about this post