শিক্ষার আলো ডেস্ক
দুইটি হাত না থাকার পরও মুখে কলম ধরে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা কক্সবাজারের চকরিয়ার অদম্য বাহার উদ্দিন রায়হান আরো একটি চমক দেখিয়েছেন। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে হাসি–ঠাট্টার পাত্র হওয়া রায়হানের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত সোমবার ( ১৫ মে ) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রায়হানের হাতে তুলে দিয়েছেন চাকরির নিয়োগপত্র। ঢাকায় আইসিটি ভবনের সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নিয়োগপত্র তুলে দেন।
প্রতিমন্ত্রী পলক নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘আজ অন্য রকম একটি দিন আমাদের জন্য। শৈশবে দুই হাত হারানো অদম্য তরুণ বাহার উদ্দিন রায়হান আজ যোগ দিলেন আইসিটি পরিবারে, Training Coordinator হিসেবে। এনহান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (EDGE) প্রকল্পের অধীনে ১,০০,০০০ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল সে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে আমাদের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।’
২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট অদম্য রায়হানকে নিয়ে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি এইচএসসি পাস করেছিলেন। মুখে কলম আটকে ধরে পরীক্ষার খাতায় লিখে জেএসসি ও এসএসসি পাস করেন তিনি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ছোটকালে দুই হাত হারানো রায়হান। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে একটি ভালো চাকরি পাওয়ার। অবশেষে তার স্বপ্নের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাহার উদ্দিন রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন বাড়ির কাছে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে ঢুকে পড়া একটি চড়ুই পাখিকে বাঁচাতে গিয়ে ঝলসে যায় তার হাত ও পায়ের তালু। দীর্ঘ চিকিৎসার পর কেটে ফেলতে হয় দুই হাত। এভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান তিনি। তবু পড়ালেখা ছাড়েননি। মনোবল আর সাহস ছিল তার সঙ্গী। হাত না থাকলেও মুখ দিয়ে লিখে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
রায়হানের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের জহিরপাড়ায়। শিশু বয়সেই হারাতে হয় বাবা বশির আহমদকে। আপনজন বলতে আছেন শুধু মা খালেদা বেগম। বাবার কোনো সম্পত্তি না থাকায় মামাদের ভিটায় এক টুকরো জায়গায় মা ও নিজের জন্য একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন।
এসএসসির পর এইচএসসি পড়াকালীন রায়হান মামার বাড়িতে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন। সেখানে প্রতি মাসে ৪–৫ জনকে বেসিক কম্পিউটার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ওয়েবসাইট খোলা, অফিস ব্যবস্থাপনা, পাওয়ার পয়েন্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। এতে যা আয় হতো তা দিয়েই চলত তার পড়ালেখা ও সংসার। পাশাপাশি তার মা বাড়িতে আয়বর্ধক কাজ করতেন।
চকরিয়া আবাসিক মহিলা কলেজের শিক্ষক সুজন কান্তি নাথের কাছে ইংরেজি বিষয়ে পাঠ নিতেন রায়হান। তিনি বলেন, পড়ালেখায় তার বেশ আগ্রহ ছিল। দুই হাত না থাকার পরও প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় মুখে লিখে পাস করেছে। সে আজ আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ট্রেনিং কো–অর্ডিনেটর’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। সেজন্য আমরা গর্ববোধ করছি।
জীবনের স্বপ্নপূরণের প্রতিক্রিয়ায় বাহার উদ্দিন রায়হান নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, দুই হাত হারানোর পর থেকে কিছু মানুষ আমাকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ–তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন। তখন থেকেই মনে মনে পণ করেছিলাম, আমাকে যে যাই বলুক তাতে মনকে ছোট করব না। সফলতার জন্য চেষ্টা করে যাব আজীবন। আজ সেই চেষ্টার চূড়ান্ত সফলতা এসেছে। এজন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি মহোদয়ের প্রতি শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কারণ আমার বিষয়টি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হয় এবং আমাকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
Discussion about this post