রিদওয়ান বিন ওয়ালি উল্লাহ
সফলতার অব্যর্থ মন্ত্র হচ্ছে সৃজনশীলতা। এই সৃজনশীলতা সন্তানের ওঠাবসা ও চালচলনে বিকশিত করে তোলার প্রথম সুযোগ আসে বাবা-মায়ের। তাদের চেষ্টার ফল প্রতিফলিত হয় সন্তানের শিক্ষাদীক্ষায় ও কর্মযজ্ঞে। বাবা-মায়ের ভাষা আর প্রদর্শিত আচরণই তার শিক্ষার প্রথম রেফারেন্স। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ড. অ্যালিসন গোপনিক বলেন, জন্মের সময় থেকেই শিশুর আক্ষরিক শিক্ষা শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিশু যে ভাষার ধ্বনি শুনেছে তা এবং অন্য ভাষার শব্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তাই শিশুর আচরণ ও ভাষার ব্যবহারে হাতেখড়ি হয় বাবা-মা ও আশপাশের মানুষের হাতে।
শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে—এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে বাবা-মাকে ভূমিকা রাখতে হয় আবশ্যিকভাবে। কারণ সে এখন নতুন শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের নজরে ভর্তিকৃত প্রতিটি শিশুর সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা সংরক্ষিত থাকবে। যেখানে অবশ্যই শিশুর মানসিকতা, চাহনি কৌশল, মেজাজের গতিধারা, চাওয়া-আকাঙ্ক্ষা, ধারণক্ষমতা, আচরণের গতিবিধি, যোগাযোগের ধরন ইত্যাদি মোটাদাগে বর্ণিত থাকবে। যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের শিক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হয়। সেজন্য বাবা-মায়ের ভূমিকা সবার আগে ধর্তব্য। বাবা-মা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত সৃজনশীলতা বিকাশের নির্ভুল ও অতুলনীয় কর্মকৌশল রচিত হবে।
শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত সমন্বয়ের অভাবই মৌলিক প্রতিবন্ধকতা। যা বর্তমান সময়ে দারুণভাবে ভোগাচ্ছে। সমন্বয়ের দায়িত্বটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যথানিয়মে গ্রহণ করা সহজ। সমন্বয়ের কাজটি বাস্তবায়নে বাবা-মাকে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
অথচ ইদানীং বাবা-মাই শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন! বাবা-মা রোবটিক সন্তান গড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। প্লে, নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রি ও ফোর—এই ধাপগুলোতে অধিকাংশ বিষয়ে শিশু বাবা-মা ও শিক্ষকের শেখানোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। আর কিছু বিষয়ে শিশু বাবা-মা, শিক্ষকের সহযোগিতায় নিজের মননের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়। ৫ম শ্রেণি থেকে কিছু বিষয় ছাড়া সবক্ষেত্রেই শিশু নিজের সৃজনশীলতা বিকাশে সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষক শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করলেও বাবা-মা সেই সুযোগটা দিতে চান না।
২০০৪ সালের কথা। গ্রামের একটি আবাসিক প্রতিষ্ঠানে আমি দেখেছি, ৫ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নিজেই নিজের নোট প্রস্তুত করছে। পরে সে শিক্ষককে সেটা দেখিয়ে আরো পরিমার্জিত করে নিচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে এই চিত্রটির উলটো পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাবা-মাই শিশুর বিকাশের সুযোগটা বন্ধ করে দিচ্ছেন। শিশু যে নিজের মনন কাজে লাগিয়ে কোনো একটা বিষয়কে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়াার চেষ্টা করবে, সেটা হতে দিচ্ছেন না। শিশুকে সম্পূর্ণ রেডিমেড কাজে অভ্যস্ত করে ফেলছেন। বাসার হোম টিউটর কিংবা স্কুল শিক্ষক ও প্রচলিত গাইড বইয়ের ওপর পুরো নির্ভরশীল করে দিচ্ছেন। কোনো কোনো বাবা-মা ১০ম কিংবা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ের জন্য হোম টিউটর রাখছেন। এতে শিশুর চিন্তার জগত্টা ছোট হয়ে আসে। সে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সমস্যা মোকাবিলায় দক্ষ হতে পারে না।
নতুন কারিকুলামের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ আমিও পেয়েছি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ও টিজি মূল্যায়ন করে আমার কাছে মনে হয়েছে, এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে রেডিমেড পদ্ধতিতে রোবটিক শিক্ষার্থী হওয়া থেকে বের করে আনার চেষ্টা আছে। এখানে গত্বাঁধা পরীক্ষা পদ্ধতির ওপরে উঠে শিক্ষার্থীর সুপ্ত সৃজনশীলতা বিকাশের পরিকল্পিত শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
শিখন পদ্ধতি হয়ে গেছে দক্ষতাভিত্তিক। ধারাবাহিক শিখনের মধ্য দিয়ে সে নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে সৃজনশীল হয়ে উঠবে। আবার সেটা শুধু ক্লাস রুমে নয়। বরং সৃজনশীলতা বিকাশের সমন্বিত পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। নানান বিষয়ে সে বাবা-মা, বড় ভাইবোন, পরিবারের সদস্য কিংবা নির্ধারিত বিষয়ে জ্ঞান থাকা কাছের কারো সঙ্গে আলোচনা করবে, প্রয়োজনে শিক্ষক বা বাবা-মায়ের সহযোগিতায় নির্দিষ্ট স্থান ভ্রমণ করবে, লাইব্রেরিতে তথ্যের উত্স খুঁজবে, সহপাঠীরা মিলে গ্রুপ ওয়ার্ক করবে, শিক্ষকের উপস্থিতিতে সবার সামনে মতামত উপস্থাপন করবে, গ্রুপের মতামতে সমন্বয় করবে ও সর্বোপরি শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। ফলে যে কোনো বিষয়ে সে সৃজনশীল মতামত প্রদানের দক্ষতা অর্জন করবে।
কেউ কেউ পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছেন। কিন্তু উল্লিখিত সমন্বয় কৌশলটি ১০০% স্বচ্ছতা ও ঐকান্তিকতার সঙ্গে সম্পাদন করলে আশা করা যায় কারো অভিযোগ থাকবে না।
লেখকঃ শিক্ষক, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা সেনানিবাস।
Discussion about this post