বিশেষ প্রতিবেদক
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ প্রধান ও সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ পদত্যাগ করেছেন।মঙ্গলবার (৫ মে) সংগঠনটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টের মাধ্যমে কিশোর কুমারের পদত্যাগের বিষয়টি জানানো হয়। এতে বলা হয়, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত হলেও সাম্প্রদায়িক বিতর্কের অবসান ঘটাতেই দ্রুত এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রকাশ করা হলো।
এর আগে বিদ্যানন্দকে ঘিরে সম্প্রতি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ওঠে।
এই পোস্টে বলা হয়, ‘বিদ্যানন্দ’ নামটি দিয়েছেন এক মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্ট। ‘আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন’ স্লোগানের সঙ্গে মিল রেখে তিনি নামটি দিয়েছিলেন। অনেকেই এটাকে ব্যক্তির নাম থেকে ভেবে ভুল করেন। এজন্য আমরা দুই বছর আগে নাম পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটে করি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ভোট দেন।
বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন। ৯০ শতাংশ মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরাই চালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবুও উদ্যোক্তার ধর্ম পরিচয়ে অনেকেই অপপ্রচার চালায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কার্যক্রম, অনুদানের গতি।
গত মাসেই বিদ্যানন্দ প্রধান পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবকদের। সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে নয়, বরং ব্যক্তিগত ত্যাগে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করা এবং নতুন মেধায় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে এমন সিদ্ধান্ত। আর তিনি প্রধানের পদ ছাড়লেও বিদ্যানন্দ ছাড়ছেন না, সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন।
‘আমরা বিষয়টি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম চলমান ক্যাম্পেইনের পরে। কিন্তু কিছুদিন ধরে চলা মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারে জল ঢালতে খবরটি আজ শেয়ার করলাম।আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বিষয়টি হতাশার নয়। বরং পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার এই সমাজে উল্টোপথে হাঁটতে পারার জন্য গর্ব হচ্ছে। আর বিদ্যানন্দে পদে কি যায় আসে? এখানে তো কাজটাই আসল, আর সেটাই আমরা করে ছাড়বো।’
বিদ্যানন্দ প্রধানের পদ ছাড়লেও সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদেই থেকে যেতে চান কিশোর কুমার।
অন্যদিকে করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাসের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সহকর্মীরা।তিনি কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন শেষ না হওয়া অবধি চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকছেন বলে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক সালমান খান ইয়াসিন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “উগ্রবাদী কিছু সংগঠন আর ফেইসবুক ইউজার কারও কারও নেগেটিভ কমেন্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আমাদের চেয়ারম্যান। তাছাড়া কাজের এত চাপও তিনি সামলাতে পারছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থেকে কাজ করবেন।
“তারপর তিনি হঠাৎ চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা তার রিজাইন লেটার অ্যাকসেপ্ট করি নাই। কোভিড-১৯ ক্যাম্পেইন শেষ হলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত তিনি চেয়ারম্যানের পদে বহাল থাকছেন।”
সালমান আরও বলেন, “কিশোর কুমার দাস প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে গেলে যোগ্য কাউকে না পেলে পদটি শূন্য থাকবে।”
২০১৩ সালে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর কুমার দাশ। ১২টি শাখার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজারের বেশি পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও অসচ্ছল শিশুর মৌলিক শিক্ষা, এক টাকার বিনিময়ে খাবার, এক টাকায় চিকিৎসা এবং এক টাকায় আইনসেবা দেওয়া হয়। এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে পোশাক, শিক্ষা উপকরণ, মাসিক বৃত্তিসহ সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে বিদ্যানন্দ। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষে নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে শিশুদের জন্য খাতা তৈরি করে ব্যাপক প্রশংসিত হয় বিদ্যানন্দ।
করোনা শুরুর পর গণপরিবহনে জীবাণুমুক্তকরণ, সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য খাবার, চলতি পথে পথিকের ক্ষুধা নিবারণ, শহরের রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো কিংবা রাস্তার অসহায় কুকুরকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে নানা কাজে যুক্ত প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাসেবকরা। সাম্প্রতিক করোনাসংকটে যখন চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক, নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট ছিল তখন বিদ্যানন্দ নিজেদের বাসন্তী গার্মেন্টসে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বানিয়েছে। সেই পিপিইগুলো বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।মসজিদ, হাসপাতাল, বাস, রেলস্টেশনের মতো জায়গাগুলো যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে, সেখানে জীবাণুনাশকও ছিটিয়েছে।
দেশের এই সঙ্কটকালে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ত্রাণ নিয়ে পুরো শহরময় ছুটছে এর স্বেচ্ছাসেবীরা৷ সশস্ত্র বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায়ও ত্রাণ পাঠাচ্ছে।
এ ধরণের একটি মহতী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে যারা তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছে মুক্তচিন্তার লক্ষ লক্ষ মানুষ।
Discussion about this post