মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ
শরীরের উত্থান-পতন, রোগ-ব্যাধি মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। শুধু রমজান নয়, অসুস্থতা নিয়ে যে কোনো সময় ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। করতে হয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা। যার কোনো কোনটা রোজা ভঙার কারণের মধ্যে গণ্য হলেও কোনো কোনোটায় আবার রোজার ভাঙার কারণ নয়।
জরুরি চিকিৎসার জন্য যেসব পরীক্ষায় রোজা ভঙ্গ হয়, তাতে শুধুই কাজাই আদায় করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না। নিচে এই জিজ্ঞাসাগুলোর মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. কোভিড-১৯ পরীক্ষা: কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষায় রোজা নষ্ট হবে না। কারণ এক্ষেত্রে তুলা লাগানো শলাকা নাকের বা গলার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে লালা সংগ্রহ করা হয় যাতে কোনো ওষুধ লাগানো থাকে না।
২. ইনজেকশন: ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙবে না। ইনজেকশন রোজা ভাঙার কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তায় নেওয়া হয় না।
৩. এনজিওগ্রাম: হার্ট ব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়ার দিকে কেটে একটা বিশেষ রগের ভেতর দিয়ে হার্ট পর্যন্ত চিকন নল ঢুকিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তাকে বলা হয় এনজিওগ্রাম। এনজিওগ্রাম করলে রোজা ভাঙবে না।
৪. অ্যান্ডোসকপি: এটি পাকস্থলির এক ধরনের পরীক্ষা। একটি সরু পাইপ যার মাথায় ভাল্পযুক্ত থাকে সেটি পাকস্থলিতে প্রবেশ করিয়ে বাইরে থেকে মনিটরের মাধ্যমে পাকস্থলির অবস্থা নিরূপণ করা হয়। ওই পাইপে যদি কোনো ওষুধ লাগানো থাকে তাহলে রোজা নষ্ট হবে, তা না হলে রোজা নষ্ট হবে না।
৫. অক্সিজেন: রোজা রাখা অবস্থায় ওষুধ ব্যবহৃত অক্সিজেন নিলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে শুধু বাতাসের অক্সিজেন নিলে রোজা ভাঙবে না।
৬. রক্ত দেওয়া-নেওয়া: রোজা রেখে রক্ত দিলে বা নিলে রোজা নষ্ট হয় না।
৭. সিস্টোসকপি: প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে করা এক ধরেনের পরীক্ষার নাম সিস্টোসকপি। এর দ্বারা রোজা ভাঙবে না।
৮. সিরোদকার অপারেশন: অকাল গর্ভপাত নিরোধ কল্পে অপারেশনটি করা হয়। এতে জরায়ুর চারপাশ সেলাই করে সঙ্কুচিত করে দেওয়া হয় যাতে গর্ভপাত না হয়। এতে কোনো ওষুধ বা অন্য কোনো কিছু খাদ্যনালি বা শ্বাসনালি দিয়ে প্রবেশ করেন না। সুতরাং, সিরোদকার অপারেশন করালে রোজা নষ্ট হবে না।
৯. আল্ট্রাসনোগ্রাম: আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে যে সব ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় সবই থাকে শরীরের উপরিভাগে। কোনো কিছুই শরীরের ভেররে প্রবেশ করানো হয় না। তাই আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে রোজা নষ্ট হবে না।
১০. স্যালাইন: স্যালাইন নেওয়া হয় রগে যা রোজা নষ্ট হওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়। তাই সেলাইন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজা রাখার কারণে যে কষ্ট বা দুর্বলতা সেটা দূর করার জন্য সেলাইন নেওয়া মাকরূহ।
১১. টিকা নেওয়া: টিকা রোজা নষ্ট হওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তায় ব্যবহার করা হয় না। সুতরাং, টিকা নিলে রোজা ভাঙবে না।
১২. ইনসুলিন ব্যবহার করা: ইনসুলিন নেওয়া হয় ডায়াবেটিকের রোগীর সুগার কামানোর জন্য। আর ইনসুলিন রোজা ভাঙার কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তায় ব্যবহার করা হয় না। সুতরাং ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙবে না।
১৩. রক্ত পরীক্ষা: রোজা রেখে ডায়াবেটিকের সুগার বা অন্য যে কোন ধরনের পরীক্ষার জন্য শরীর থেকে রক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হবে না।
১৪. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার: রোজা রেখে চোখে কোনো ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হয় না যদিও তার স্বাদ গলায় অনুভূত না হয়।
১৫. কানে ওষুধ প্রয়োগ: রোজা রেখে কানে যদি কোনো ওষুধ বা তেল দেওয়া হয় তাহলে এর দ্বারা রোজা নষ্ট হবে না।
১৬. আলগা দাঁত মুখে রাখা: রোজ রাখা অবস্থায় যদি নকল বা আলগা দাঁত মুখের ভেতর রাখা হয় তাহলে এর দ্বারা রোজা নষ্ট হবে না।
১৭. হিজামা বা সিংগা লাগানো: রোজা রেখে হিজামা বা সিংগা নিলে রোজা নষ্ট হবে না।
১৮. ইনহেলার: শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য একটি তরল জাতীয় ওষুধ মুখের ভেতর দিয়ে স্প্রে করে গলায় প্রবেশ করানো হয় একে বলা হয় ইনহেলার। ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
১৯. নাইট্রোগ্লিসারিন: এটা হার্টের ব্যথা উপশমকারী এক ধরনের ওষুধ যা এক/দু ফোঁটা জিহ্বার নিচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় ওষুধটি রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং ওষুধের কিছু অংশ গলার মধ্যেও প্রবেশ করে। বিধায় নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
২০. প্রক্টোসকপি: পাইলস, ফিস্টুলা, অর্শ্ব, হারিশ বা বুটি রোগের পরীক্ষার নাম প্রক্টোসকপি। একটি নল মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। নলের সঙ্গে রোগী যেন কষ্ট না পায় সে জন্য তরল ওষুধ (গ্লিসারিন সদৃশ) ব্যবহার করা হয়। প্রক্টোসকপি করলে রোজা ভেঙে যাবে।
২১. ঢুস লাগানো: মলদ্বার দিয়ে যে কোনো ঢুস ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
২২. নাকে ওষুধ দেওয়া: নাকে ওষুধ দিলে যদি তা খাদ্যনালিতে চলে যায় তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
২৩. দাঁত তোলা: রোজা রেখে জরুরি প্রয়োজন না হলে দাঁত তোলা মাকরুহ। যদি একেবারে নিরূপায় হয়ে দাঁত তোলার সময় যদি ওষুধ গলায় চলে যায় অথবা থুথুর সমপরিমাণ বা তার থেকে বেশি রক্ত গলার ভেতর চলে যায় তাহলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।
২৪. ডিএন্ডসি: গর্ভবর্তী মায়ের জীবন রক্ষার্থে বিশেষ পদ্ধতিতে ৮-১০ সপ্তাহের মৃত বা জীবিত বাচ্চাকে বের করে আনাকে ডিএন্ডসি বলা হয়। এতে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা আদায় করতে হবে। আর কারণ ছাড়াই ডিএন্ডসি করলে কাজা ও কাফফারা উভয়ই আদায় করতে হবে।
লেখক: পেশ ইমাম, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।
Discussion about this post