শিক্ষার আলো ডেস্ক
নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মিথ্যাচার করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ১৫টি ভূল তথ্যের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই অপপ্রচার সম্পর্কে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল সচেতন থাকতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নতুন শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে ১৫টি ভুল নিয়ে সেগুলোর বিষয়ে সঠিক তথ্য জানান।
শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া ১৫টি ভুল তথ্যের ব্যাখ্যা :
পড়াশোনা নেই, পরীক্ষা নেই
ভুল তথ্য: পড়াশোনা নেই, পরীক্ষা নেই, শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না।
সঠিক তথ্য: শিক্ষার্থী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পড়বে, নিজেরা সক্রিয়ভাবে পড়বে, শিখবে। দলগত কাজ করে আবার তা নিজেরাই উপস্থাপন করবে। শুধু জ্ঞান নয়, দক্ষতাও অর্জন করবে। আর মূল্যায়ন হবে প্রতিটি কাজের। আবার ষান্মাসিক মূল্যায়ন এবং বাৰ্ষকি মূল্যায়নও হবে। কাজেই পরীক্ষা ঠিক থাকছে, কিন্তু পরীক্ষার ভীতি থাকছে না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং না হওয়া আছে। শুধু তাই নয়, পারদর্শিতার ৭টি স্কেলে তাদের রিপোর্ট কার্ডও আছে।
বিজ্ঞান
ভুল তথ্য: আগে নবম দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ছিল ৪০০ নম্বরের: নতুন শিক্ষাক্রমে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১০০ নম্বরের!
সঠিক তথ্য: নতুন শিক্ষাক্রমে কোনো বিষয়ের জন্যই নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ নেই, আছে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার পর্যায়। কাজেই এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই।
ভুল তথ্য: নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু কমিয়ে দেওয়া হয়েছে!
সঠিক তথ্য: নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত সকল শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সময় রাখা হয়েছে। কাজেই সার্বিক দিক দিয়ে আগের চেয়ে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বেড়েছে, বিষয়বস্তুর পরিধিও বেড়েছে।
ভুল তথ্য: ব্রিটেনের কারিকুলামে নবম শ্রেণিতে বিষয় বাছাইয়ের সুযোগ আছে, কিন্তু বাংলা মাধ্যমে তা রাখা হয়নি।
সঠিক তথ্য: প্রচলিত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম এবং ইংল্যান্ডের জাতীয় শিক্ষাক্রম এক নয়। ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের শিক্ষাক্রমেই নবম (ক্ষেত্রবিশেষে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয় নির্বাচনের সুযোগ থাকে না।
ভুল তথ্য: শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষাকে খাটো করতে বিভাগ বিভাজন তুলে দেওয়া হয়েছে!
সঠিক তথ্য: নবম শ্রেণিতে পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশেই বিভাগ বিভাজন করা হয় না। দশম বা একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে সাধারণত বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
উপকরণ
ভুল তথ্য: প্রচুর উপকরণ কিনতে হয় ফলে শিক্ষা বায় অনেক বেড়েছে।
সঠিক তথ্য: দামি উপকরণ, চাকচিক্য বা সৌন্দর্য এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। স্থানীয়, সহজলভ্য ও পুনঃব্যবহারযোগ্য কাগজ ও উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশনা বার বার দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যয় বাড়ার কোনো কারণ নেই। আর নোট বই কিংবা কোচিংয়ের খরচ তো লাগবেই না।
ভুল তথ্য: গ্রামের স্কুল উপকরণ পাবে না বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকরণ কেনার সামর্থ্য নেই ফলে বৈষম্য বাড়ছে।
সঠিক তথ্য: তৃণমূল পর্যায়ে সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেই উপকরণ, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ইত্যাদি নির্বাচন করা হয়েছে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই বিকল্প উপায় রাখা হয়েছে, ফলে বৈষম্য তো নয়ই বরং গ্রামের বিদ্যালয়গুলো। ভালো করছে। তাছাড়া কোচিং, গাইড বইয়ের ব্যয় লাগছে না ফলে বৈষম্য কমছে এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ভালো করছে।
বাড়িতে দলগত কাজ/রান্না
ভুল তথ্য: বাসায় গিয়ে দলগত কাজ করতে হয়, যা বাস্তবে সম্ভব নয় ফলে ডিভাইস নির্ভরতা বাড়ছে।
সঠিক তথ্য: সকল দলগত কাজ বিদ্যালয়ে করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। বাড়িতে কোনো দলগত কাজ দেওয়া হয় না।
ভুল তথ্য:বিদ্যালয়/শিক্ষকরা বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে আসতে বলেন।
সঠিক তথ্য: বাড়ি থেকে রান্না করা কোনো খাবার আনার নির্দেশনা নেই। জীবন দক্ষতার অংশ হিসেবে শুধু একটি অভিজ্ঞতায় নির্দিষ্ট ক্লাসে রান্নার কাজ আছে।
ভাষা
ভুল তথ্য: শিক্ষার্থীরা লিখছে না ফলে বানান, ব্যাকরণ ইত্যাদি শিখছে না।
সঠিক তথ্য: যেকোনো সময়ের চেয়ে শিক্ষার্থীদের এখন বেশি লিখতে হচ্ছে, কারণ প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অভিজ্ঞতায় তাদের বিভিন্নভাবে প্রায়োগিক লেখার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে শুধু বানান বা ব্যাকরণ নয়, শিক্ষার্থীরা এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের প্রয়োজনে লিখতে পারছে।
গণিত
ভুল তথ্য: গণিতে অনুশীলনের সুযোগ নেই।
সঠিক তথ্য: প্রতিটি গণিতের ধারণা এখন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তব পরীক্ষা ও ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা করছে।
ধর্মশিক্ষায় লিখিত পরীক্ষা
ভুল তথ্য: ধর্মশিক্ষায় লিখিত পরীক্ষা রাখা হয়নি।
সঠিক তথ্য: সকল বিষয়ের জন্য একই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে লিখিত মূল্যায়নও অর্ন্তভুক্ত আছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার সুযোগ কম
ভুল তথ্য: শিক্ষা দক্ষতাভিত্তিক করতে গিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার সুযোগ কমে গিয়েছে।
সঠিক তথ্য: বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে জেনে, বুঝে, উপলব্ধি ও অনুধাবন করে। তা প্রয়োগ করার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় নতুন ধারণার অনুসন্ধান করা। মুখস্থনির্ভরতা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কী হবে?
ভুল তথ্য: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার জন্য তাদের সন্তানরা ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না।
সঠিক তথ্য: এই শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থীরা যখন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভর্তি প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন হবে। সেসব কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
ভুল তথ্য: চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সন্তানদের ফলাফল কাজে আসবে না।
সঠিক তথ্য: চাকরির ক্ষেত্রেও পারদর্শিতার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই নিয়োগ হবে। সেসব কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
উল্লিখিত অপপ্রচারগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত জানুয়ারিতে এরা সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার লক্ষ্যে বই নিয়ে মিথ্যাচার করেছিল। এরা চায় না শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে শিখতে, চিন্তা করতে শিখুক। অনুসন্ধিৎসু হোক, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করুক। ওরা চায় মগজ ধোলাইয়ের শিক্ষাই চালু থাকুক।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যেকোনো পরিবর্তনই মেনে নিতে, খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হয়। আর রূপান্তরকে মেনে নেওয়া আরও কষ্টকর। কিন্তু বুঝতে হবে, এই রূপান্তর এগিয়ে যাবার জন্য অবশ্যম্ভাবী। এর কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র বিকল্প হলো পিছিয়ে পড়া, নতুন প্রজন্মের জীবনকে ব্যর্থ করে দেওয়া। যা আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। অভিভাবকরা সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবুন। তাদের লক্ষ, যোগ্য মানুষ হবার কথা ভাবুন। তাদের যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়ে উৎকর্ষ লাভের কথা ভাবুন। একবার ভীষণ প্রতিযোগিতার চিন্তা থেকে বেরিয়ে সহযোগিতার, সহমর্মিতার চর্চার মধ্য দিয়ে সন্তানের ভালো মানুষ হওয়ার কথা ভাবুন।
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, শিক্ষকদেরও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ চলছে। তাদেরও জীবনমান উন্নয়নে সরকার আরও পদক্ষেপ নেবে। কারণ এরও কোনো বিকল্প নেই। কাজেই নতুন শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানান। নতুন প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনার সকল দ্বার উন্মুক্ত করে দিন। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আপনার সমর্থনের মাধ্যমে আপনিও শরিক হোন। সুতরাং অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজে যাচাই করুন, সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করুন।
তিনি বলেন, স্বার্থান্বেষী কোনো মহলের ফাঁদে পা দেবেন না। শিক্ষায় রূপান্তর একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ, এর বিকল্প নেই। সরকার শিক্ষকদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে যা চলমান রয়েছে। সকলের সহযোগিতায় এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার যথাযথ বাস্তবায়ন আমাদের শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।
Discussion about this post