আসিফ মোক্তাদির
আমেরিকায় আসার পর আমার প্রথম কাজ ছিল একটি কফির দোকানে। কফি বানানোর পাশাপাশি ঝাড়ু দেওয়া, মাঝেমাঝে হাঁটু গেড়ে বসে ও শুয়ে পুরো দোকান ধোঁয়ার কাজও করতে হতো। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছিল পুরো দোকানের ময়লা/গার্বেজ দিনশেষে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে ফালানো। কারণ গার্বেজ ফেলতে গিয়ে দশ-পনেরো মিনিট ফোন চালানোর সুযোগ পাওয়া যেত। কফি বানাতে বানাতে যখন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন এই স্বল্প সময় কফি বানানো থেকে বিরতি নিয়ে শরীর যে কীরকম আরাম পেতো তা বর্ণনা করার মতো নয়।
ময়লার ব্যাগ বেশি ভারী হয়ে গেলে মাঝেমাঝে ব্যাগ ছিড়ে অর্ধেক ময়লা আমার উপর নতুবা মাটিতে পড়ে যেত। তারপর সেই ময়লা পরিষ্কার করতে যেয়ে শরীরের অবস্থার আবার বারোটা বেজে যেত। গার্বেজ ফেলতে গিয়ে বেশি সময় লাগানোর জন্য প্রায়ই শ্রীলংকান ম্যানেজারের গালিগালাজ শুনতে হতো। এইসব গালিগালাজ শুনে রাগে দু:খে নিজেকে কন্ট্রোল করা কষ্টকর হয়ে যেত। মাঝেমাঝেই ঘরে ফিরে আব্বু-আম্মুর সাথে রাগ করতাম, কান্নাকাটি করতাম।
আমি আমেরিকায় আসি পারিবারিক ভিসায়। আমার মতো নতুন আসা অভিবাসী হিসেবে পারিবারিকভাবে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থায় আমেরিকায় আবার পড়াশোনা শুরু করার কল্পনা করতে পারার সাহস করাও ছিল অনেক বড় ব্যাপার। প্রথম দিকে আমেরিকায় ছিল আমাদের অভাব অনটনের সংসার। আমি যে সময় আমেরিকায় আসি তখন প্রায় পাঁচ-ছয় মাস ধরে আব্বুর চাকরি নাই। জমানো টাকা থেকে ঘর ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার খরচ চালিয়ে আমাদের নাজেহাল অবস্থা। আমেরিকায় আসা আমার মতো অভিবাসীদের এসব অসহনীয় যন্ত্রণা, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি অনেক সময় বাড়ি, গাড়ি আর ডলারের আড়ালে চাপা পড়ে যায়।
ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকে ফলাফল খুব একটা খারাপ ছিল না। তাই আমেরিকায় এসে কফির দোকানে কাজ করি শুনে অনেক কাছের আত্মীয় স্বজন আম্মুকে ফোন দিয়ে বলত সারা জীবন পরিশ্রম করে, পড়াশোনা করে এখন শেষপর্যন্ত আমাকে কফির দোকানে কাজ করতে হচ্ছে; আমার পেছনে ব্যয় করা আম্মুর সারাজীবনের কষ্টই নাকি বৃথা গেছে। অনেকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করত ছেলের পেছনে এত শ্রম দিয়ে এখন লাভটাই বা কী হল? আমার সহজ-সরল আম্মু কোনদিনই আমাকে এসব কথা বুঝতে দেন নি; কান্না করলে বুকে জড়িয়ে আমাকে শান্তনা দিয়েছেন।
সারাদিন কফি আর স্যান্ডউইচ বানাতে বানাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে যখন দেখতাম কাছের বন্ধুরা দেশে পড়াশোনা করছে; আর কয়েকদিন পরেই একেকজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পাশ করে বের হবে আর এ দেশে আমার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার কোন সম্ভাবনাই নেই তখন আম্মুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কান্না করতাম। কি এক অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার পরিবার ও কিছু কাছের মানুষের সহযোগীতায় সেই দু:সহ কষ্টের দিন পেছনে ফেলে এসেছি আলহামদুলিল্লাহ।
And you know, what is the most proudest moment for me in life so far? My mother called those straight outta my gradution ceremony and told them, “I just finished my son’s graduation ceremony and he is driving me home now”. She was crying louldly in the backseat of the car holding my brother and saying, ” বুক ফাটিজিতো মাইনসোর ইতা মাত হুনিয়া, আইজ জীবন স্বার্থক”।
কফির দোকানে কাজ করি বলে যারা আমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল, জীবনে ব্যর্থ হয়েছি বলে যারা ধরেই নিয়েছিল তাদেরকে খুব একটা খুশি হওয়ার সুযোগ আমি দেই নি। বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে মেজর ও কেমিস্ট্রিতে মাইনর করে আমি আমার ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেছি।
“Never stop dreaming. Wake up and chase your dreams”. ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হব। যারা আমার এ স্বপ্নের কথা জানত কফির দোকানে কাজ করি বলে তারা আরো মজা নিত। আলহামদুলিল্লাহ আমি সেই ছোটবেলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এখনো ছুটছি। আগামী তিন বছর মেডিকেলের সাদা এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ পড়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হবে।
এটাই হল আমেরিকার সৌন্দর্য। লক্ষ্য ঠিক করে পরিশ্রম করলে যেকোন কিছুই করা সম্ভব এখানে। আমার মতো গার্বেজ ম্যান থেকে যেকোন লক্ষ্যে পৌঁছানো। Land of oppurtunity- perfectly said.
Discussion about this post