নিউজ ডেস্ক
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। গত ১ থেকে ৯ মে পর্যন্ত সারাদেশে ৫ হাজার ৪০০ জন ভাইরাসের কবলে আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ রোগীই রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগের। গত ৯ দিনে শুধু ঢাকাতেই ৪ হাজার ৩৫৫ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি তিন মিনিটে ঢাকায় ১ জন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে।
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তত ৩১টি জেলায় ঢাকায় করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এপ্রিলের শুরুতেই রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা মহানগরীর ১৭টি, নারায়ণগঞ্জের ১১টি, গাজীপুরের ৭টি, কিশোরগঞ্জের ৬টি, নরসিংদীর ৫টি ও মুন্সীগঞ্জের ৫টি হটস্পট থেকেই এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি করোনার প্রকোপ বেড়েছে। ঢাকা মহানগরী ভিন্ন অন্যসব জেলার এসব হটস্পটের বেশিরভাগই শিল্প অধু্যষিত এলাকায়।
আইইডিসিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯ মে পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর হটস্পট- রাজারবাগ ২০০ জন, মিরপুরে ১৮৪ জন, কাকরাইলে ১৭৩ জন, যাত্রাবাড়ীতে ১৬৯ জন, মুগদায় ১৫৬ জন, মহাখালীতে ১৫৯ জন, মোহাম্মদপুরে ১৩২ জন, লালবাগে ১০৬ জন, তেজগাঁওয়ে ১০১ জন, মালিবাগে ৮৩ জন, উত্তরায় ৮১ জন, পুরান ঢাকার বাবুবাজারে ৭৯ জন ও বংশালে ৭৪ জন বিভিন্ন সময় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের ১১টি হটস্পটের মধ্যে যে ৫টিতে ১ থেকে ৯ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা, সদর উপজেলা, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও ও আড়াইহাজার। এ ৫টি হটস্পটই ঘনবসতিপূর্ণ এবং সেখানে শ্রমজীবী মানুষের আনাগোনা সব সময়ই বেশি। সরকারের অঘোষিত লকডাউন কখনো এসব এলাকায় সেভাবে মানা হয়নি। বিশেষ করে গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এসব হটস্পটে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবণতা অনেকাংশেই উধাও হয়ে গেছে। গার্মেন্ট অধু্যষিত এলাকাগুলোতে শ্রমিক জটলা আগের চেহারায় ফিরেছে।
এপ্রিলের শেষভাগে সহস্রাধিক গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার পর গাজীপুর সদর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, চান্দনা ও কোনাবাড়িসহ সেখানকার ৭টি হটস্পটের সবগুলোতেই করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে বলে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ দাবি করেছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, মে মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে সেখানে বিপুল সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হবে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি দুজন পোশাক শ্রমিকের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ওই শ্রমিকদের করোনা সংক্রমণের প্রকৃত উৎস ও বিস্তরণের তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নরসিংদীর ৫টি হটস্পটের মধ্যে সদর উপজেলা, বেলাবো ও রায়পুরা এ তিনটি এলাকায় মে মাসের শুরু থেকে করোনা সংক্রমণ নতুন করে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। পলাশ ও শিবপুর হটস্পটে নতুন করে রোগীর সংখ্যা উচ্চ হারে না বাড়লেও সেখানকার আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে নরসিংদী এবং এর বাইরের জেলায় বেশকিছু মানুষ সংক্রমিত হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে মুন্সীগঞ্জের হটস্পটগুলোতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা খুব বেশি না হলেও সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনার উপসর্গ রয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া গত কয়েকদিনে সদর উপজেলা, সিরাজদিখান ও শ্রীনগরের হটস্পটে উপসর্গহীন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় ঢাকা মহানগর এবং ঢাকা বিভাগের ৫টি জেলায় করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু হারের ব্যাপকতার নেপথ্য কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ৭টি বিষয়কে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন।
তারা জানান, ঢাকা বিভাগের বাইরের বেশিরভাগ জেলায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা রাজধানীর একেকটি হটস্পটের চেয়েও কম। অথচ সারাদেশে অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দারাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে ৬ এপ্রিল থেকে গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক লাখ শ্রমিকের ট্রাক-কভার্ডভ্যানে গাদাগাদি করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরে ফেরা এবং পরবর্তীতে গার্মেন্ট না খোলায় ফের তাদের গ্রামমুখী হওয়ার কারণে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এছাড়া রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জের বিপুল সংখ্যক উপসর্গহীন করোনা আক্রান্ত শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ায় তাদের মাধ্যমে এ মরণব্যাধির বিস্তার ঘটেছে।
এছাড়া বিদেশ থেকে আসা মানুষের মাধ্যমেই ঢাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। কেননা প্রবাসীদের অনেকের পরিবারই ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেই থাকেন। তারা করোনার ভয়ে বিদেশ থেকে পালিয়ে এসে পরিবারের মাঝেই ফিরেছেন। আবার অনেকের পরিবার ঢাকায় না থাকলেও বিদেশ থেকে ফেরার পর আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেনাকাটার জন্য বেশকিছু দিনের জন্য ঢাকায় অবস্থান করেছেন। অথচ তাদের দেশে ফেরার সময় করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। এমনকি কেউ হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নিয়মও মানেননি। এ অবস্থায় উপসর্গবিহীন প্রবাসী রোগীদের সংস্পর্শে এসে ঢাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের উপ-পরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনাভাইরাস যেহেতু বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করা মানুষের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তাই ঢাকাতে ভাইরাসের প্রকোপ বেশি থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক।
এছাড়া সারাদেশে অঘোষিত লকডাউনের পরও ঢাকায় গণপরিবহণ বন্ধ থাকলেও রিকশা-ভ্যান, রেন্টে কারের গাড়ি, বিভিন্ন পণ্যবাহী মিনি কভার্ডভ্যান, ট্রাক অনেকটা নির্বিঘ্নেই এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল করেছে। যা এ মহানগরীতে সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, করোনাভাইরাস কোনো একটি সমতলে বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকে। অর্থাৎ কোনো একটি রিকশা, গাড়ি বা গণপরিবহণে একজন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি ভ্রমণ করলে সেখানে তা লেগে থাকতে পারে এবং পরে আরেকজন ওই পরিবহণ ব্যবহার করলে তাকে সংক্রমিত করতে পারে।
Discussion about this post