শিক্ষার আলো ডেস্ক
শীতের আমেজ রেখেই এসে হাজির হয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। কুয়াশার মোড়ক খোলা পলাশের ঝাড়ে কোকিলের কুহুতান। প্রকৃতি প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন সাজের। ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করার উৎসব চারদিকে।
১. আজি দখিন-দুয়ার খোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।
দিব হৃদয়দোলায় দোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥
প্রকৃতি যখন তার দখিন-দুয়ার খুলে দেয়, বইতে শুরু করে ফাগুন হাওয়া, মধুর অমৃত বাণী শোনা যায় কোকিলের কণ্ঠে, রঙের উচ্ছ্বাস জাগে অশোক-পলাশ-শিমুলে, বেরিয়ে আসে শীতের খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম, আর এসব ফুলে ফুলে ভ্রমর করে খেলা; তখনই যেন প্রবল বিক্রমে আগমন ঘটে রাজাধিরাজের, ঋতুরাজ বসন্তের। পহেলা ফাল্গুন দিনটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্ত্যলোকে অভিষেক ঘটে ঋতুরাজের, আর তাকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি নেয় এক বর্ণিল সাজ। গাছে গাছে জাগে নতুন পাতা, নতুন ফুলের সমারোহ। সবাই যেন মত্ত শীতের শুষ্কতাকে প্রাণপণে আড়াল করার চেষ্টায়। অবশ্য ফুল যদি না-ও ফোটে, বসন্তের আগমনধ্বনিকে কোনোভাবেই চাপা দেয়া যায় না। কারণ কবি যে বলেই দিয়েছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।’
বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি অতি জাঁকজমকের সাথে পালিত হয় বসন্ত বরণ উৎসব। পহেলা বৈশাখের পর এটি যেন বাঙালির দ্বিতীয় প্রাণের উৎসব। এ দিনটিতে প্রকৃতির সাথে সাথে বাসন্তি সাজে সেজে ওঠে এই বাংলার মানুষেরা।
জানা গেছে, ১৫৮৫ সালে মোগল সম্রাট আকবর ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বসন্ত উৎসব’। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে সকাল সকাল জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে ঢাবির চারুকলার বকুলতলায় শুরু হয় নানা আয়োজন। এর উদ্বোধনী পর্বের শুভ সূচনা হয় সমবেত বাদ্যযন্ত্র ও রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
বসন্তকে বরণ করে নিতে ভোর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ ও নানা বয়সী লোকজনের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে যেন এক মিলনমেলায় রূপ নেয় চারুকলা প্রাঙ্গণ।
এবারও রাজধানীতে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উদ্যাপন পরিষদ। সকালে চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় যন্ত্রসংগীতের সুর মূর্ছনা দিয়ে শুরু হবে এ উৎসব। ১০টা পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একযোগে অনুষ্ঠান চলবে চারুকলার বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে।
এ উৎসবে থাকবে যন্ত্রসংগীত, বসন্ত কথন পর্ব, প্রীতি বন্ধনী, আবির বিনিময়, একক আবৃত্তি, দলীয় আবৃত্তি, একক সঙ্গীত, দলীয় সঙ্গীত, দলীয় নৃত্য, শিশু-কিশোরদের বিশেষ পরিবেশনা।
২.
আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে…
ঠিক তা-ই। অনেকের কাছেই বসন্ত হলো প্রেমের ঋতু। প্রেমের বার্তা নিয়েই যেন আগমন ঘটে ঋতুরাজের। পশ্চিমা সংস্কৃতির দেখাদেখি আমাদের দেশেও ভ্যালেন্টাইনস ডে’র প্রচলন ঘটেছে বেশ কয়েক যুগ ধরেই, কিন্তু আকাশে-বাতাসে, হৃদয়ে-মননে প্রেমের আলোড়ন তুলতে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের বসন্ত বরণও কোনো অংশে কম নয়। বরং একদিন আগে-পরে বসন্ত বরণ উৎসব ও ভ্যালেন্টাইনস ডে’র আবির্ভাব বলে, বাঙালি সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে চায় এমন অনেকের কাছে প্রকৃত প্রেমের দিন হিসেবে পহেলা ফাল্গুনটিই বিবেচিত হয়। এদিন নতুন কচিপাতার দোলায় দুলতে থাকে প্রকৃতি, আর সেই সাথে দুলতে থাকে প্রেমতৃষ্ণার্ত মানুষের আবেগী মনও। এমন অনেকেই আছে যারা সারা বছর অপেক্ষা করে এই দিনটিতে ভালোলাগার মানুষের কাছে মনের কথাটি বলতে। আবার এই দিনে রাস্তাঘাটে, পার্কে, বিনোদনকেন্দ্রে, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বাসন্তি শাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের আনাগোনা অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। আমাদেরও চাওয়া, মানব-মানবীর প্রেমের সম্পর্ককে মহিমান্বিত করতে একটি বিশেষ দিনের প্রয়োজন যদি হয়ই, তবে তা পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে ধার করা ভ্যালেন্টাইনস ডে নয়, হোক আমাদের বাঙালি জাতির একান্ত আপনার পহেলা ফাল্গুনই।
বসন্তের এই দিনে ভালোবাসা দিবস প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মনও রাঙিয়ে দিয়েছে। এই ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্ব যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতেও। তারা ভালোসার উপলব্ধি থেকে প্রাণনাশের বিধ্বংসী চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুক, পৃথিবী শান্তিময় হোক।
Discussion about this post