ড. মুনাজ আহমেদ নূর
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা খুব একটা খারাপ অবস্থায় না থাকলেও এটা দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের উপযোগী। তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী হয়ে এটা এখনো গড়ে উঠেনি। যদি চতুর্দশ শতকের জার্মান ক্লাসরুমগুলো দেখি তাহলে দেখব একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা তার সামনে বসে লেকচার শুনছেন এবং পরবর্তী সময় তা মুখস্থ করছেন। আমাদের আজকের ক্লাসরুমগুলোরও একই অবস্থা। এর থেকে আমরা এখনো বেরুতে পারিনি। প্রযুক্তিগত কিছু সংযোজন হলেও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে খুব একটা পরিবর্তন এখনো আসেনি। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ, এই শিক্ষাব্যবস্থাকেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তৈরি করা। কীভাবে সেটি করা যাবে তাই নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। গভীর মনোযোগ দিতে হবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট শিক্ষায় রূপান্তরে। মঙ্গলবার (১২ মে) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, শিক্ষা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বা বলা ভালো মানুষের সামাজিকীকরণের উপায়। প্রত্যেক দেশ বা সমাজের একটি নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা থাকে। থাকে তার কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যও। সাধারণত তিনটি উদ্দেশ্যকেই মুখ্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়। প্রথমত তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ও জ্ঞান আহরণের জন্য, দ্বিতীয়ত দক্ষতা অর্জনের জন্য এবং তৃতীয়ত সামাজিক ও মানবিক হওয়ার জন্য। তবে ১৯৮৯ সালে ইউনেস্কো একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো জানার জন্য শিক্ষা বা শিখন, দ্বিতীয়টি হলো কাজের জন্য শিক্ষা বা শিখন, তৃতীয়টি হচ্ছে মিলেমিশে বসবাস করার জন্য শিক্ষা বা শিখন এবং চতুর্থটি হচ্ছে উৎকর্ষ সাধন, বিকাশ ও অন্যের প্রতি সহানুভ‚তিশীলতা অর্জনের জন্য শিক্ষা বা শিখন। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ইউনেস্কোর প্রথম দুটি উদ্দেশ্য থাকলেও মিলেমিশে বসবাস বা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা অর্জনের জন্য যে শিক্ষা বা শিখন তা অনেকটাই অনুপস্থিত। প্রকৃত নাগরিক গড়তে, মানবিক স্মার্ট মানুষ গড়তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার দিকে জোর দিতে হবে। অথচ সেটিই এখনো পারছি না আমরা।
আমি প্রথমেই বলেছি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ও জ্ঞান আহরণের জন্য শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা যে বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা বিবর্জিত তা কিন্তু না। আমরা আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের যুব সমাজকে এই দুটো বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি বা কোনো কাজে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছি। আপাত অর্থে সেটা ঠিক থাকলেও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে মিলেমিশে বসবাসের শিক্ষা এবং অন্যের প্রতি সহানুভ‚তিশীলতা অর্জনের শিক্ষার বিকল্প নেই। এজন্য আমরা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষা প্রদান করতে পারি। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষায় ও আমাদের নতুন জ্ঞানও সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে অবধারিতভাবেই পিছিয়ে পড়তে হবে আমাদের।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় ইনস্ট্রকটিজম, কনস্ট্রাকটিজম এবং কানেক্টিভিজম এই তিন ধরেন ক্লাসরুম শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। আমাদের কনস্ট্রাকটিজমে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এটাকে আমরা বলছি প্রজেক্ট, প্রবলেম এবং এক্সপেরিয়েন্স বেইজ লার্নিং। আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান পৃথিবীতে যে জ্ঞান আছে সেই জ্ঞানকে প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পুনরায় নতুন করে উৎপাদনের চেষ্টা করতে পারি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী সমাজে চলার নিয়ম, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং অন্যের কাছে তা স্থানান্তর করতে শিখবে। এই পদ্ধতিকেই আমরা বলছি জ্ঞানের পুনরুৎপাদন বা কনস্ট্রাকটিভিজম। এখানে শিক্ষার্থীরা কাজ করতে করতে শেখেন। শিক্ষক এখানে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে জ্ঞানের স্থানান্তর।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার জন্য জ্ঞানের স্থানান্তর অত্যাবশ্যক তবে জ্ঞানের পুনরুৎপাদন করতে পারলে শিখন অনেক সহজ হয়ে যায়। অনেক দেশেই ইতোমধ্যে এই পদ্ধতিগুলোকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও আমরা এখনো এর থেকে দূর আছি। ইনস্ট্রাকটিজম পদ্ধতিতে শিক্ষক ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে লেকচার দেন এখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি শেখেন। আর কানেক্টিভিজম হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ বা প্রদান। এই নেটওয়ার্কটা ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক হতে পারে আবার ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কও হতে পারে। এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক অঙ্গ সংগঠন থাকে এর মাধ্যমে শিখতে পারে আর ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের মতো ইন্টারনেট ভিত্তির নেটওয়ার্ক থেকেও শিখতে পারে।
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে আমরা এখনো এই ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আসতে পারিনি। আমরা এখনো পঠন ও মুখস্থের মধ্যেই আটকে আছি। এর বাইরে যা আছে সেগুলো আমরা শিক্ষার মাধ্যমে আনতে পারছি না। এটা আমরা দিচ্ছি তবে ক্লাসরুমের বাইরে। ক্লাসরুমে এটি করা গেলে আমাদের শিক্ষা অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং উপভোগ্য হবে। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ক্লাসরুম হবে অনেক বেশি সংযুক্ত এবং এখানে কোলাবোরেশনের মাধ্যমে তারা একসঙ্গে কাজ করতে পারবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং সক্ষমতা বাড়বে যা একবিংশ শতাব্দীতে টিকে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ক্রিটিকাল থিংকিং সক্ষমতা না থাকলে শিক্ষার্থী কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সমস্যা সমাধান না করতে পারলে সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাকে কোনো ডাটা দেয় হলে তা সে অ্যানালিস করতে পারবে না। আর এগুলো সম্ভব স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট শিক্ষায় পরিণত করতে নিম্নের প্রস্তাবনাটি কাজে লাগানো যেতে পারে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ ক্লাউড নির্ভর। এখানে কোনো ধরনের হার্ডওয়ারের প্রয়োজন হবে না। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে প্রথমত স্কুল ইন ক্লাউড, দ্বিতীয়ত কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং তৃতীয়ত, রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউড। এগুলোর প্রত্যেকটি একেকটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটিকে ট্রেনিং টুল হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে ট্রেনিংয়ের বিষয়গুলো থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শিখতে পারবে।
স্কুল ইন ক্লাউডে প্রথমে একটি স্কুলকে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে এসে এখানে ভালো ভালো শিক্ষকের লেকচার আপলোড করা যেতে পারে। এই লেকচারগুলো অন্য শিক্ষকরা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সেগুলো তারা ব্যবহার করতে পারেন অথবা তারা নতুন করে তৈরি করতে পারেন। এই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটি কীভাবে ব্যবহার করবে তাও এর মধ্যে থাকবে। এর ফলে খুব সহজে অনেক বেশি শিক্ষককে এই স্কুল ইন ক্লাউডের মাধ্যমে সংযুক্ত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যাবে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরাও জড়িত থাকবে। তারা লেকচারগুলো দেখবে, তাদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবে, অন্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করবে। এরপর কমিউনিটির কিছু স্কুলকে একই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। এর ফলে আরো দশটি স্কুলের মধ্যে যুক্ত হবে এবং এর আওতা আরো বড় হবে। সর্বশেষ রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউড এসব বিভাগের স্কুলকে একই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে এর ফলে শিক্ষা এবং ট্রেনিং খুব দ্রæত হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারবে।
আমরা যদি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে স্কুল ইন ক্লাউড, কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউডে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে দেশের সব শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। আবার আমাদের শিক্ষার্থীরা যে কোনো দুর্যোগকালে এই ক্লাউড ব্যবহার করে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারবে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশের সব স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে কিছুটা সময় শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা বা ক্লাস থেকে দূরে রয়েছে। যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এই পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। আর যদি আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে চাই অথবা আমাদের সমাজকে স্মার্ট করতে চাই তাহলে শুধু তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ও জ্ঞান আহরণ এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করলে হবে না। আমরা সমাজে কীভাবে মিলেমিশে বসবাস করব, কীভাবে উৎকর্ষ সাধন ও অন্যের প্রতি সহানুভ‚তিশীল মানুষ তৈরি করব সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : ড. মুনাজ আহমেদ নূর : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি।
Discussion about this post