এস,এম, সারওয়ার
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এবার জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক পাচ্ছেন দেশের ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।গত ১ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ তথ্য প্রকাশ করে । তন্মধ্যে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০১৯–এ জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিকা নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা খায়রুন নাহার লিপি।
লক্ষ্য যেখানে অটুট,কর্ম যেখানে দীপ্তিময় আর শির যেখানে নতজানু,সাফল্য সেখানে অনিবার্য- এই নীতিতে বিশ্বাসী এই বিদুষী নারী ২০০১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে প্রথম যোগদান করেন পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার প্রত্যন্ত একটি স্কুলে।বাবা গলাচিপা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল খালেক মিয়া এবং মা কাউন্সিলর নাছিমা বেগম এর একমাত্র সন্তান লিপি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও এম,এড সম্পন্ন করেছেন।ছাত্র জীবনে সুন্দর হাতের লেখা ও সংগীতের জন্য শিশু একাডেমি থেকে পুরষ্কার লাভ করেছেন।
ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী সংস্কৃতিমনা এই কন্যাকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্নটা একটু বড়ই ছিলো। মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এমনটি কোনমতেই মেনে নেননি পরিবার!কিন্তু শিশুদের শেখানোর প্রতি চরম আগ্রহ ছিল যে তার।সবার মতকে উপেক্ষা করেই তাই এ পেশায় পদার্পণ।অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই অর্জন!
চাকুরির শুরু থেকেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গুরুদায়িত্বকে মহান ব্রত হিসেবে মেনে নেন তিনি। শ্রেণী পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন নতুন কৌশলের উদ্ভাবনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে বিদ্যালয়কে মূলকেন্দ্র হিসেবে টার্গেট করে শিক্ষার্থীদের মাঝে তা জাগ্রতকরণের পরিচর্যা ছিল সবসময়।এরই ধারাবাহিকতায় সাধারণ পঠন-পাঠন কাজের বাইরে বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে হয়েছে তাকে। মুখে বলা বা ডকুমেন্ট উপস্থাপনের মধ্যেই প্রতিভার স্বাক্ষর সীমাবদ্ধ নয়। এর জন্য ব্যবহারিক তথা সরাসরি প্রমাণও রাখতে হয়েছে। আর এগুলোই যোগ্যতা প্রমাণের মাপকাঠি।
পদকপ্রাপ্তির বিষয়ে তিনি জানান, প্রতিযোগিতাটা হয় শিক্ষকতার দক্ষতা, অতিরিক্ত পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতার ওপর। পদকপ্রাপ্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো তাকে সহায়তা করেছে বলে তিনি মনে করেন তার মধ্যে রয়েছে একাধিক প্রশিক্ষণ, সংগীতে পারদর্শিতা , জাতীয় গণমাধ্যমে পাঠদান ও উপস্থাপনা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত শেখানো, জাতীয় দিবসগুলোতে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নিজের লেখা গান, কবিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি।সর্বোপরি নিজের আছে যতটুকু জানা তার সবটুকুই শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি মানবিকতার চর্চাকেও অগ্রাধিকার দিয়েছেন এই গুণী শিক্ষক।নিজ উদ্যোগে পথশিশুদের স্কুলগামী করে প্রশংসিত হয়েছেন খায়রুন নাহার। মিরপুর আর,সি স্কুলে থাকাকালীন মাজার রোড থেকে কয়েকজন নেশাগ্রস্ত ছিন্নমূল শিশুকে নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এনেছেন মানবিক শিক্ষক খায়রুন নাহার। নিজের সংগীত প্রতিভাকে বিদ্যালয়ের শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কমপক্ষে চারজন অসহায়, দরিদ্র কিংবা মাতৃহীন শিশুদের প্রতিবছর শিক্ষা সহায়তা,ছয় থেকে সাতজন শিক্ষার্থীর ইউনিফর্ম প্রদান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের টিফিন বক্স প্রদান সহ শিক্ষাবান্ধব বেশ কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। প্রশাসনও তাঁকে উৎসাহিত করেছে ২০১৭ সালে ঢাকা জেলার এবং ২০১৮ সালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত করে।
শ্রেষ্ঠত্বের পদবীর সমান্তরালে দায়িত্বও যায় বেড়ে।স্কুলের দায়িত্বের পাশাপাশি কাজ করছেন UNODC কর্তৃক আয়োজিত Family United programme এ মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে । পাশাপাশি বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে এবং করোনা সংকটময় মূহুর্তে সংসদ টেলিভিশন ও বেতারে সম্প্রচারিত পাঠদান কার্যক্রমে সংযুক্ত রয়েছেন। সংসদ টিভিতে তিনি এখন জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে লায়ন্স ইন্ট্যারন্যাশনালের তিনি একজন সদস্য। সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে উপস্থাপনা,লেখালেখি ও সংগীতচর্চাও চলছে।
তাঁকে নিয়ে সহকর্মীদের মূল্যায়ন – “পেশাগত কাজে খায়রুন নাহারের দায়িত্ববোধ, আগ্রহ ও উদ্দীপনা অনুসরণীয়। অসম্ভব পরিশ্রমী খায়রুন নাহার দীর্ঘ ১৯ বছরের কর্মজীবনে শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। প্রতিটি কর্মস্থলেই তিনি শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তানের মতো যত্ন নিয়েছেন। তাই অভিভাবকদের কাছেও তিনি এক আস্থা ও ভালোবাসার নাম। শ্রেণি পাঠদান এবং নিয়মিত কার্যক্রমে আন্তরিক অংশগ্রহণের পাশাপাশি শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে সদা সচেষ্ট থাকেন। মমতাময়ী এ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিরাপদ এক আশ্রয়স্থল”।
শ্রেষ্ঠতম হওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে এই শিক্ষিকা বলেন,“ শোকরিয়া মহান সৃষ্টি কর্তার প্রতি যার অশেষ কৃপায় আজকের এ দান।অবনত চিত্তে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের আমার সকল অভিভাবক, আমার নিবেদিত প্রাণ সহকর্মী, আমার বন্ধু বান্ধব, আমার পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি যাদের অক্লান্ত শ্রম, সহনশীলতা আর ত্যাগের বিনিময়ে আজকের সাফল্য গাঁথা। হৃদয়ের সকল নিংড়ানো শ্রদ্ধাবোধ যাদের পথপ্রদর্শনের জন্য আজকের এ বিজয় তাদের প্রতি। জাতীয় পর্যায়ের এ গৌরবগাঁথা আমি একা বহন করতে চাইনা। আমার এ অর্জন প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সকলের। আমার এ অর্জন সবার জন্য আমি উৎসর্গ করলাম।সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করতে পারি” ।
Discussion about this post