নাজিয়া ফেরদৌস
‘sincerity
of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’ পিতা শেখ লুৎফর রহমানের এই সততা ও সচেতনতার বাণীকে মর্মে ধারণ করে পথচলা শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার ‘বসেই তো আছ , লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’ এই অনুরোধে যিনি বলেছিলেন ‘…এমন কি করেছি যা লেখা যায়!…নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ তাঁর হাতেই রচিত হয়েছে অসাধারণ এক জীবনী-সাহিত্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। এ শুধু একটি আত্মজীবনী নয় বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি অসাধারণ সাহিত্যিক প্রকাশ। ১৯৬৭ সালে রচিত হলেও বইটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী একটি সাহিত্য হিসেবে প্রাণ পায়। সাধারণ আত্মজীবনীমূলক
গ্রন্থগুলোতে নিজের মহিমা প্রচারের ও নিজ কৃতিত্বকে তুলে ধরার যে সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়- এই গ্রন্থটি তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একজন অসাধারণ নিরপেক্ষ প্রকৃত দেশপ্রেমিকের হাতেই এ সাহিত্যের নির্মাণ সম্ভব।
এ যেন একটি জীবনী গ্রন্থ নয়, বইটি পড়লে কখনো মনে হবে একটি অসাধারণ গল্পের বই, কখনো মনে হবে বাংলার ইতিহাস যেন কোনো সাহিত্যিক সাবলীল ভাষায় নিজের মতো করে বলে যাচ্ছেন- যার কোথাও কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, নেই কিছু লুকোবার প্রয়াস। ১৯৩৪ থেকে শুরু করে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। গ্রন্থের শুরুটা হয়েছে ঠিক উপন্যাসের মতো করে। একটি গ্রামের ছেলে বর্ণনা দিচ্ছে তার বংশের, তারপর মাত্র ১২ বছরে বাল্যবিবাহের কাহিনীও বলে গেছেন অবলীলায়। ১৯৩৬ সালে এই বালক প্রথম রাজনীতিতে পা রাখেন সুভাষ বসুর ভক্ত হয়ে। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর
হাত ধরে। তাঁকেই লেখক সব সময় আদর্শের স্থানে রেখেছিলেন। বয়স খুব কম হলেও ছেলেটির সাহস ছিল অসাধারণ, বন্ধুকে রক্ষায় যিনি বলতে পারতেন-‘ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নইলে কেড়ে নেব।’ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই প্রথম জেল খাটতে হয় তাঁকে।এরপর অসাধারণ সব সংগ্রামে পার হয় ১৯৪৩, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১। মানুষের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রমে অতিবাহিত হয় তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত। মানুষের জন্য, দেশের জন্য তিনি যাত্রা করেছেন চাকরদের কামরায়, থেকেছেন বেকার হোস্টেলে অর্ধাহারে ও অনাহারে। তবুও হাল ছাড়েননি। সাম্প্রদায়িকতা
তিনি পছন্দ করেননি কখনোই বরং হিন্দু-মুসলিম সবাইকে এক করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। কোটারির বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। নিজের ঢোল পেটাতে মোটেও পছন্দ করতেন না, পছন্দ করতেন না আপস করতেও। তাই সোহরাওয়ার্দীকেও তিনি বলতে পেরেছিলেন-‘আপস করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আমরা খাজাদের সাথে আপস করব না।’ বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে ঠিক যেন অর্ধশত বছর আগের কোনো পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি। কোথাও কোনো ফাঁক নেই, দম ফেলার অবসর নেই। অসাধারণ বয়ান ভঙ্গি তরতর করে টেনে নিয়ে চলে একেবারে গ্রন্থের শেষ পর্যন্ত। এ গ্রন্থের পরতে পরতে চমক আর সরলতা, সততা ও সংগ্রামের নজির। সাথে রয়েছে বিদেশ ভ্রমণের চাঞ্চল্যকর বর্ণণা, পড়লে মনে হয় এ যেন কোনো ভ্রমণ গ্রন্থ। শুধু দেশের রাজনীতির আগাগোড়া বর্ণনাই নয় এতে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর মনোভাবও, একজন সুদক্ষ ঔপন্যাসিক যেমন করে নিজের মতকে মিলিয়ে দেন লেখার সাথে ঠিক তেমনি। অনেক ক্ষেত্রে তিনি তুলনাও করেছেন ‘এরা শিল্পকারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময় কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার বেশির ভাগই ব্যয় হলো জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে।’ দেশকে এই মহান পুরুষ প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। নেতার অহংকার তাঁর ছিল না বলেই তিনি বলতে পারতেন-‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে।’ ১৯৫৫ পর্যন্ত তিনি লিখতে পেরেছিলেন এই অসাধারণ ইতিহাস এরপর আরো অনেক চড়াই উৎরাই তিনি পার করলেও তা লিপিবদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্রে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ই একটি উপযুক্ত শিরোনাম।
জীবন মানেই সাহিত্য। তবে সব ঘটনা যেমন কাহিনীর রূপ পায় না তেমনি সব রচনাও সাহিত্য হয় না। অসাধারণ আত্মজীবনীও উন্নত সাহিত্যের মর্যাদা পেতে পারে, যদি তা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অনুরূপ। সত্যিই এ এক অসাধারণ গ্রন্থ। যে কোটারি আর দুর্নীতির ফাঁদে আমরা আজ জর্জরিত, তা কোনোদিন কাম্য ছিল না তাঁর। কোটারি আর পক্ষপাতহীন সমাজ চেয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের মানুষের। রাজনীতিকে এত নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বয়ান করা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি প্রকৃত অর্থে কোনো দলের নন, নন বিশেষ কোনো শ্রেণীর। তিনি সারা বাংলার মানুষের, তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবার যার স্পষ্ট নজির তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আদর্শ একজন দেশনায়ক, আদর্শ দেশপ্রেমিকের নজির বহন করে চলেছে এই গ্রন্থ। আজকের তরুণ সমাজ ও ভবিষ্যৎ কাণ্ডারীদের জন্য এটি কেবল একটি অনুসরণীয় আদর্শই নয়, নয় শুধু সংগ্রামী জীবনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এটি ইতিহাসের মৌলিক দলিলও বটে।
Discussion about this post