সাঈফ আলম
১. সৃষ্টি বৈচিত্র্যে সৃষ্টিকর্তার সৌন্দর্য জ্ঞানের যে সকল মূর্ত—বিমূর্ত প্রকাশ ও বন্দোবস্ত আকাশ ও জমিনে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে তার মধ্যে ভাষা বৈচিত্র্য একটা অনন্য বিষয়। সম্ভবত ভাষা হলো সেই বিশেষ উপাদান যা মানুষকে মানুষ করেছে। ভাষা না থাকলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন সম্ভব হতো না; সে পশুদের কাতারেই রয়ে যেত। সৃষ্টির শুরুতেই মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেছে তার অন্যান্য সকল মানব অনুভূতিগুলো অপরাপর মানবের সাথে আদান প্রদানের জন্য।কার্য—কারণের দুনিয়ায় ভাষা মানুষের মরণ—বাঁচনের নিয়ামক। ভাষা ব্যবহার করতে না দিলে মানুষ একদিনও বাঁচতে পারে না। ভাষাই বন্ধন তৈরী করে আবার এই ভাষাই বিবাদ বাঁধায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পৃথিবীর যত যুদ্ধ—বিগ্রহ তা যতটা না বিষয়ের কারণে তার চেয়ে বেশি বুলির (ভাষার) কারণে বাধে।”
কিন্তু পৃথিবীতে ভাষা তো মাত্র একটা নয়, দুইটাও নয়, প্রকৃতপক্ষে হাজার হাজার অস্তিত্ব রয়েছে দুনিয়ায়। সেই ভাষার পরিচয়ে জগৎজুড়ে নিযুত কোটি মানুষেরা বিচিত্র ও স্বাতন্ত্র হয়ে বসবাস করে চলেছে। ভাষা বৈচিত্র্যে ও স্বাতন্ত্রের মধ্যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার যে একটা বিশেষ সৃষ্টি সুখ আছে সে কথা পবিত্র কোরানেও উল্লেখ আছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি মানুষকে বিভিন্ন ভাষায় (জাতি ও গোষ্ঠীতে) বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তারা একে অপরকে চিনতে পারে।’ বৈচিত্র্য না থাকলে পৃথিবীতে আবিষ্কারের কিছু থাকতো না। এক বাঙালী আর এক বাঙালী দেখে আশ্চর্য হবে না। সে বরং আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইবে, বুঝতে চাইবে চাইনিজ কাউকে দেখে। কারণ চাইনিজ মানুষের মধ্যে যত অবাঙালী বেশিষ্ট্য আছে তা হবে বাঙালী বা অন্য যে কোন অ—চাইনিজদের জন্য আগ্রহের ও আবিষ্কারের বস্তু। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এভাবেই ভাষা বৈচিত্র্য মানুষকে সৃষ্টিশীল বা কৌতুহলী বানিয়েছে পৃথিবীর নানা ভাষা—ভাষী গোষ্ঠীকে জানার ও বোঝার জন্য । ঈশ্বরের নিজ হাতে বন্টন করা এই ভাষা বৈচিত্র্যের গায়ে যারা হাত তোলে তারা আসলে আল্লাহর সাথে পাল্লা দিয়ে বসে। তারা বৈচিত্র্য বিনষ্টকারী, তারা খোদাদ্রোহী।
এই বিবেচনায় ১৯৫২ সালে পাকিস্থানীদের খোদাদ্রোহিতার স্বভাব ন্যাংটা হয়ে ধরা পড়েছিল বিশ্ববাসীর সামনে। তারা চেয়েছিল বাংলা ফেলে বাঙালী উর্দু ভাষা কোলে তুলে নিক। তবে বাঙালী ছাত্র সমাজ সেদিন উদুর্র পদতলে বাংলাকে পিষ্ট হওয়া দেখতে চায়নি, মানতেও চায়নি। তারা বুঝেছিল পাকিস্থানীদের এই ভাষা শাসনের অভিলাষ (যা খোদাদ্রহীতার সমান) থেকে নিবৃত্ত করতে হলে বিনয়াবনত কোন দরখাস্ত দাখিল করলে হবে না, প্রতিবাদ করতে হবে। শুধু বুলি আওড়ালে হবে না, স্বার্থ (জীবন) ও দিতে হবে। তাই যেমন ভাবনা তেমন কর্ম। ২১শে ফেবু্রয়ারী শফিক, রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতেরা উন্মুক্ত বাঙালী বুক দিয়ে পাকিস্থানের বুলেট দমিয়েছিল। এভাবেই বাঙালীর মুখের ভাষা আবার মুখেই নির্ভয়ে স্থায়ী হলো। তবে ৫২’তেই পাকিস্থানীদের সাথে বাঙালীর প্রীতি নষ্টের শুরু। ৭১—এ এসে চূড়ান্ত শেষ। কিন্তু রক্তে খরিদ করা সেই বাংলা ভাষার আদর ও কদর আজ বাঙালীর কাছে কতখানি তা আন্তরিকভাবে মূল্যায়ন করার উপযুক্ত সময় হয়েছে। সেই ৫২, সেই ২১ আজ সংখ্যার অধিক কোন তাৎপর্য আমাদের জীবনে বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালীদের জীবনে বহন করে কিনা তাও আজ বিশেষ মনোযোগ দিয়ে বিচার্য বিষয়।
২. জোর যার মুল্লুক তার— এই কথাটি বিশ্বজনীন ও চিরন্তন। এ কথা শুনতে ও মানতে মানুষের যতই আপত্তি থাক আর মানুষ যতই অস্বস্তি অনুভব করুক না কেন গায়ের জোরের চিরকালীন চর্চা আজও পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ কোন ব্যবস্থার দ্বারাই অপসারণ করতে সক্ষম হয়নি। গণতন্ত্র দ্বারা পারেনি, কমিউনিজম দিয়েও পারেনি। অন্যান্য জানা—অজানা কোন ব্যবস্থাই এই উদ্দেশ্যে একশত ভাগ সফল হয়েছে বলে স্বাক্ষ্য দেওয়ার বা প্রমাণ দেখাবার কেউ আছে কি না তা অনুসন্ধানের বিষয়। গায়ের জোরে মুল্লুক দখলের চিত্র—বিচিত্র আমরা আমাদের নিজ প্রতিবেশেও দেখি, পরদেশেও এর খবর শুনে থাকি। এই সেদিনও মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গদের মুল্লুক দখলের অভিপ্রায়ে গায়ের সমস্ত জোর খাটাতে দেখা গেল ক্যাপিটল হিলের ভেতরে, বাইরে, ছাদে। যদিও মুল্লুক শেষ পর্যন্ত হাত ছাড়া হয়ে গেছে। তবে তাতে গায়ের জোরে মুল্লুক দখলের বিশ্বাস তাদের দূর হয়ে গেল সে কথা কিন্তু বলা যাচ্ছেনা। কারণ এটা শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, এটা চর্চা ও অভ্যাসের বিষয়ও বটে। মার্কিনিদের সে অভ্যাস গঠনের অনুশীলন হয়েছে ইরাক দখলে, আফগানিস্তান দখলে। আরো কয়েক শতাব্দি ধরে কত শত অলিগলি দখলে তাদের সেই দখলের অভ্যেসের বায়ুবেগ বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে আজ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। জবর দখলের অভ্যাসগত অস্ত্র যে সব সময় শুধু বাইরের ভিন্ন জাতির উপরে প্রয়োগযোগ্য তা নয়। অভ্যেসবশত জোরের হাত নিজ গৃহের আপনজনের গায়েও উঠে যেতে পারে। ক্যাপিটল হিলে তারই উদাহরণ দেখলো পুরো বিশ্ববাসী। যাই হোক, মজার বিষয় হলো এই গায়ের জোরের সাথে ভাষার চল—অচলের একটা শক্ত রকমের যোগ আছে।
পৃথিবীর অঘোষিত ও অলিখিত নিয়ম এ রকম যে, এখানে গায়ের জোর যার ভাষা চলবে তার। ভাষা বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে ‘লিঙ্গুইজটিক ইমপেরিয়ালিজম’ বা ভাষার সাম্রাজ্যবাদ। তৎকালে পশ্চিম পাকিস্থানীদের গায়ে জোর ছিল। সেই জোর খাটিয়ে তারা শাসনের গন্ডি পেরিয়ে বাঙালীদের উপর শোষণের তুর্কি ঘোড়ার লাগাম খুলে দিয়েছিল। সেই ঘোড়া দাবড়িয়ে তারা আসলেন এবং বললেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে বাঙালীদের প্রধান ভাষা। সে ক্ষেত্রে বাঙালীর মাতৃভাষা বাংলা হবে তাদের জন্য অপ্রধান ভাষা।আর অপ্রধান হলেই তাকে সহজে এড়িয়ে চলা যায়। যেমন ধরুন দেশের মানুষ অ—প্রধান পত্রিকাগুলোতে সচারাচার চোখ বুলাতে চায় না। যাই হোক, ভাষার এই প্রধান—অপ্রধানের মর্যাদা নির্ভর করে ভাষাটি কার আর তার গায়ের জোর কতটুকু তার উপর।
আজ ইংরেজি ভাষা কেন জগৎবাসীর প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে তার ব্যখ্যাও কিন্তু এই সরল সূত্রে বদ্ধ। অর্থাৎ ঐ গায়ের জোরের মধ্যে নিহিত। ১৯৫২ তে আমরা বাঙালীরা আমাদের উপর পাকিস্থানীদের ভাষাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদের উৎসাহকে তার প্রকাশ পর্যন্তই থামিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের উপর তা চর্চা করার কোন সুযোগ রাখি নাই। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আমাদের কাছে অপ্রধান হতে দেই নাই আমরা, প্রধান করেই তাকে প্রাণে ধরে ছিলো বাঙালী। কিন্তু আজ আমরা সেই বাঙালীরাই বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালীরাই আমাদের নিজ প্রচেষ্টায় বাংলাকে অপ্রধান ভাষা করে তুলে তাকে অবজ্ঞা, অবহেলা করছি প্রতি পদে পদে। সর্বাঙ্গে ইংরেজি প্রীতির গন্ধ মেখে ইংরেজির পাশে আমাদের বাংলা ভাষাকে কি নিদারুনভাবেই না কিঞ্চতকর করে ফেলছি আমরা শিক্ষিতরা আর তাদের ঘরে বেড়ে উঠা প্রজন্মদের দল। মধুসূদন দত্তের হীরা ফেলে কাঁচ তুলে ভিখারী সাজার যে পোড়াকপালে গল্প, সে গল্প আজ কবির একার নয়।নিশ্চয় এ গল্প আমাদের আমাদের কৃষক সম্প্রদায়ের নয়। তবে ব্যাপকভাবে এ গল্প আমাদের শিক্ষিত বাঙালীদের গল্প।
৩. সময় গড়িয়েছে অনেক। এখন পাকিস্থান আমল নয়। বৃটিশ আমল ও নয়। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে,সাম্রাজ্যবাদ শেষ হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের কলের যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি কলার ও পরিবর্তন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা এখন ঘাড়ের উপরে বসে না, বসে মনের উপরে। ইংরেজি জানলেই বৃটিশদের কেরানীগিরি করে ভাল মাইনে কামানো যায়— এই সত্য একদিন বৃটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বৃটিশরা বাংলা ছেড়ে গেছে সেই কবে কিন্তু তাদের গড়ে দেওয়া বিশ্বাস আমাদের মন থেকে কখনো দূর হয়ে যায়নি। তারা এখন পশ্চিমের বাসিন্দা কিন্তু তারা তাদের সমস্তটা নিয়ে আমাদের মনে বসবাস করে এইখানে, এই বাংলায়। বস্তুত সবখানে, এশিয়ায়, আফ্রিকায়। তাদের ভাষা আমাদের হ্রদয়ে। তাদের সভ্যতা আমাদের গায়ে। তাদের সংস্কৃতি আমাদের মননে, মস্তিষ্কে, ধান্দায়। তাই তাদের ইংরেজির ভাষার সাথে ভাল কামাইয়ের, ভাল চাকরীর, উচ্চতর পড়াশুনার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আমরা নিজেরাই আমাদের মন—মস্তিষ্ক—মনন দিয়ে তৈরী করে নিয়েছি।
আমরা কর্মের জন্য কর্মী খোজার বিজ্ঞপ্তিতে পুনশ্চ দিয়ে লিখে দেই প্রার্থীকে ভাল ইংরেজি জানতে হবে। এ কথা লিখতে সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি আমাদের দেশে এসে আমাদের হাতে পায়ে ধরে না ঠিকই কিন্তু তাদের বিশ্ব বিস্তৃত পুঁজিবাদ ও অন্যান্য ব্যবস্থা বাঙালীর ভাবের জগতে এমনই সব বিশ্বাস স্থাপন করে দিয়েছে যার সার কথা হলো ইংরেজি ভাষা ছাড়া জীবনের কোন গতি নাই, ইংরেজদের পন্য ছাড়া কোন জীবন যাপন নাই, ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া কোন গন্তব্য নাই । এই বিশ্বাসের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে যা দেখা যায় তা হলো এমন যে, বাংলা দিয়ে কথা চলে কিন্তু জীবন চলে না। ফলে ইংরেজি পন্য কিনে হও ধন্য। এ রকম একটা সার্বজনীন বাঙালী মন্ত্র বিশেষত আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ধমনী ও শিরায় স্ববেগে প্রবাহিত হতে থাকে বারো মাস। “ফরেন-মেইড” ভক্ত শিক্ষক বাঙালী একুশ, বায়ান্ন, একাত্তর ইত্যাদি সব হরফ মুখের বুলি বানিয়ে অন্তরে ঠাই দিয়েছে ইংরেজির সাধনা। আমাদের শিক্ষিত ও পয়সাওয়ালাদের নতুন প্রজন্মের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম বা ইংরেজি মাধ্যমে পঠন পাঠনের ঠাট এই সাধনারই কাঙ্খিত ফসল। অথচ গবেষনা বলছে মাতৃভাষায় মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি বুঝে থাকে। এজন্য ড. সলিমুল্লাহ খানের মত পন্ডিতেরা বিদেশী জ্ঞান বিজ্ঞানের জগৎ বিখ্যাত বই পত্রের বাংলা অনুবাদ করে বাঙালীর প্রজন্মকে পাঠ করার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলা ভাষাতেই যখন উৎসাহ নেই তখন বাংলা অনুবাদের নিবেদিত কর্মী মিলবে কোথায়? বাংলা অনুবাদের পাঠকই বা খুঁজে বেড়াবেন কোনখানে? আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে খুবই কম পাবেন তা গবেষণা না করেই বলে ফেলা যায়।
৪. পশ্চিমা প্রীতি ও পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ বাঙালীকে বিশেষ করে শিক্ষিত অংশকে আত্ন অবনমনের আত্নঘাতী কর্মীতে রুপান্তর করে ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আর বাঙালীর এই পশ্চিম ভক্তির রোগের লক্ষণ নির্ণয় করেছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ঃ ‘যা কিছু পশ্চিমের তা কিছুই শ্রেষ্ঠ, তা কিছুই উৎকৃষ্ট বলে জ্ঞান করার অন্ধ বিশ্বাস বাঙালীর মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল। এতে বাঙালী যা কিছু তার নিজের , যা কিছু তার দেশের তা কিছুকে সে তাচ্ছিল্য করার সংস্কৃতি গড়ে তোলার একটা অসুস্থ্ সাধনা করেছে বহুকাল ধরে।’ এখন এই সাধনায় কয়েকগুণ বেগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, পরে বিদেশী ভাষার পত্তন’— এই কথাটার ঠিক উল্টোটাই আজ এখানে রীতি। এখনকার খেয়াল হলো আগে ইংরেজির খই ফুটাতে শিখে যাক সন্তান, পরে বাংলার বোল একটু আধটু পারুক বা না পারুক তাতে কারো জাত যাবে না। আমার ছেলের সাথে বাংলাটা ঠিক যায় না। এ কথা বলতে অনেক বাঙালী লজ্জা বোধ না করে বরং অহংকারের তৃপ্তি লাভ করে। বাংলা ভাষা এখন খালি চোখের সমান যা দিয়ে বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যায় না।
অন্য দিকে, ইংরেজি এখন দূরবীণ এর ন্যায় যা দিয়ে বহুদূর দেখা সম্ভব। দূর দেখার এই দুল দুল ঘোড়ায় চড়ার জন্য ত্যাগের কোন সীমা রাখেনা শিক্ষিত বাঙালী। সে ত্যাগে অপরাধ অন্বেষণ এই যুগে হয়ত মানায় না। কিন্তু যে বেগে—আবেগে ইংরেজি শিক্ষার দিকে আমরা হাত বাড়াই তার ঠিক দ্বিগুণ বেগে যখন আমরা বাংলা ভাষার প্রতি অনাসক্ত হই এবং অনাদর প্রদর্শণ করি তাতে প্রশ্ন আসেই, শহরে—বন্দরে শিক্ষিতদের আবাসে বাংলা ভাষার তাহলে ভূত ও ভবিষ্যৎ কী? এখনকার বাঙালী তো ইংরেজি শিক্ষাকে প্রয়োজনের ঘাট পার করে বিলাসের কূলে নিয়ে ভিড়ায়েছে। এখন তো শুধু ইংরেজি বলতে পারাটাই যথেষ্ঠ হচ্ছে না তাদের জন্য, ইংরেজিটা বৃটিশ বা আমেরিকানদের সুরে (একসেন্টে) ও স্বরে বলতে পারা চায়। অর্থাৎ কন্ঠে যেন কোন ভাবেই বাঙালী পরিচয়টা স্পষ্ট না হয়ে ওঠে, ইংরেজি কথনে যেন ”ইংরেজপনার” (ইংলিশ স্পিকারিজম) তাল, লয়,বানী সুর সব ঝনঝনিয়ে বেজে বেজে ওঠে। এটাও একটা বড় মাথা ব্যাথা অনেক শিক্ষিত বাঙালীর। ইংরেজি বা যে কোন বিদেশী ভাষা শিক্ষা দোষের নয়। ইংরেজদের মত করে যথার্থ উচ্চারণে, ঢং—এ ইংরেজি বলার চেষ্টাও নিন্দার বিষয় নয়।
কিন্তু এর মধ্যে বাঙালী পরিচয়কে গোপন করার কোন অভিপ্রায় থাকলে, বাংলা বুলিকে ধুর ছেয় করার কোন ভাব লক্ষিত হলে সেটা কিন্তু আপত্তির বিষয় বটে, কেননা কারো মত চলা বা বলার যে অন্ধ অনুকরণের বাতিক তা একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার স্পৃহা নষ্ট করে। অনুকরণ ও পরাধীনতা বরণের মানসিকতার উর্বরতা বৃদ্ধি করে। সুতরাং দেশী ভাষাকে অচল ভেবে, লজ্জার ভেবে, ইংরেজি শিক্ষা করা বাঙালীর স্বাচ্ছন্দের জন্য সহায়ক হলেও তাদের ব্যক্তি ও জাতীয় চেতনা ও মনোস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমান অবস্থাটা এমনই আশ্চর্যের যে, এদেশে কৃষক ভিন্ন অন্য কারো পক্ষে আজ নির্ভেজাল বাংলা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শিক্ষিতজন মাত্রই এখন ইংরেজি ভাষার অনিবার্য অনুপ্রবেশ মুক্ত বাংলা বুলি নিসৃত করা দুঃস্বপ্নের মত।
আমাদের প্রতি বাক্যের মধ্যেই দু’একটা ইংরেজি শব্দের অপ্রতিরোধ্য অনুপ্রবেশ ঘটবেই। এটা একটা ভাষাগত ব্যভিচার যাকে মানুষ নিন্দার্থে ‘বাংলিশ’ বলে থাকে। নির্ভেজাল বাংলা বলতে না পারা এটা এক ধরণের বন্ধাত্ব্যও বটে। রবীন্দ্রনাথের মতে বাংলাকে পাশ কাটিয়ে, অবজ্ঞা করে বাঙালীর লাভের অংকে যা পড়ে তা হলো তার (পশ্চিমাদের) অনুকরণের রুচিবোধ হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করে। বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা? সময়ের ব্যবধানে আমাদের আশাও যেমন হেরফের হয়েছে তেমনি আশা পূরণের ভাষাও বদলে গেছে। এখন আমাদের অধিকাংশেরই আশা মানে “আমেরিকান ড্রিম” বা এর সমকক্ষ কোন জীবন, আর ভাষা মানে ইংরেজি। বাংলা ভাষার এমন দুর্দশা আর দূর্গতির
দৃশ্যপট দেখে যে কোন পরিনামদর্শী বাঙালী সুধীজন মাত্রই বেদনাহত না হয়ে পারবেন না। বাস্তব সঙ্গত কারণে বৈষয়িক ভাবনা তাড়িত, আধুনিক শিক্ষিত অনুকরণপটু অধিকাংশ বাঙালীর জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী নিছক একটি অনুষ্ঠানের নাম বললে অত্যুক্তি হবে না বলে আশা করা যায়।
৫. মোদ্দা কথায়, বাংলা ভাষার প্রতি সংকীর্নতা প্রদর্শণ করে ইংরেজি ভাষা প্রীতির ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করে তাতে গা ভাসালে একুশে ফেব্রুয়ারীর চেতনাও যে ভেসে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, একেবারে বিলীন হয়ে যাবে সে কথা স্মরণে রাখাই আমাদের আধুনিক বাঙালী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রধান খেয়ালের বিষয় হওয়া বাঞ্চনীয়।
পুঁজিবাদের বানিজ্যের বাজারে লেখাপড়া শিখে ক্রয় ক্ষমতা অর্জনই শেষ কথা নয়, ক্রয় বিক্রয়ে বাছ-বিচারের তীক্ষ্ণদৃষ্টি শক্তি নিক্ষেপের যোগ্যতা অর্জনই সবচেয়ে বড় কথা। মনে রাখতে হবে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা বিশ্বগ্রামে বসবাস করতে হলে ইংরেজি ক্রয় আবশ্যক কিন্তু তা যেন কোন ক্রমেই বাংলার দামে কেনা না হয় সে ব্যাপারে সাবধান হওয়া খুবই জরুরী। বাংলাকে শুধু গ্রাম বাংলার কৃষকের গৃহেই বন্দী করা চলবে না, তাকে শিক্ষিত শহুরে ভদ্রলোকদের অট্টালিকাতেও যথাযোগ্য মর্যাদার স্থান দিতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষিত বাঙালী সম্প্রদায়কে এই অভিযোগের গানের শ্রোতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে— “ওরা ওদের মুখের ভাষা ছাইড়া দিতে চায়।”
লেখকঃ প্রভাষক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলোজি, চট্টগ্রাম।
Discussion about this post