ভালোবাসা দিবস আরো আসবে, কিন্তু এমন রোমাঞ্চকর টেস্ট ম্যাচ কি আর পাবে? তাই প্রিয় মানুষের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বসে পড়ো টিভি সেটের সামনে, উপভোগ করো ঘোর অনিশ্চয়তার এমন রান তাড়া।
এ বছরের ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’তে ক্রিকইনফোর জনৈক অনুসারীর একার অনুভূতি নয় এটা, জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইটটিতে এমন আরো অসংখ্য কমেন্ট উপচে পড়েছে গতকাল। টি-টোয়েন্টির বাজারে পানসে হয়ে পড়া টেস্ট ম্যাচও যে ‘থ্রিলার’ হতে পারে, ঢাকা টেস্ট সেটির বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল। সেই বিজ্ঞাপনে দুটি ছবির দাবি জানিয়ে রাখা যায়। প্রথমটি অবশ্যই ১৭ রানে ঢাকা টেস্টের সঙ্গে সিরিজও ২-০ ব্যবধানে জেতায় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের উল্লাস।
কর্নওয়ালের টার্নে নাঈম হাসান আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে এলবিডাব্লিউ হওয়ার সময় জয় থেকে ৪৩ রান দূরে থাকা বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে হারই দেখছেন সবাই। মিরাজের সঙ্গী হতে ক্রিজে যে তখন যোগ দিয়েছেন শেষ ব্যাটসম্যান আবু জায়েদ। বল যেভাবে মাঝেমধ্যেই লাফিয়ে বাঁক খাচ্ছে, তখন শেষ উইকেট নিয়ে অত দূর কি আর যাওয়া যাবে! তবে অনন্যোপায় মিরাজের ডাউন দ্য উইকেট এসে খেলা শট হতাশার আকাশে রং ছড়িয়েছিল।
শেষ জুটি বিধায় আধাঘণ্টা খেলার আয়ু বাড়িয়ে দেন আম্পায়ার। তখন বোলিংয়ে দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেটের জন্য ফুঁসতে থাকা রাকিম কর্নওয়াল। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে পিচ করা বলটা সুইপ শটে বাউন্ডারিতে পাঠান মিরাজ। ধুকপুকে মন তখন উদগ্রীব— ওপ্রান্তে ওয়ারিকানের ওভারটা কি সামলে দিতে পারবেন আবু জায়েদ? দিলেন প্রতিটি বলে রুদ্ধশ্বাস ডিফেন্সের প্রদর্শনী করে। পরের ওভারে আবার কর্নওয়াল। এবার তাঁর দ্বিতীয় বলটিকে লং অনের ওপর দিয়ে মিরাজ আছড়ে ফেলেন সীমানাদড়ির বাইরে, ছক্কা! এক বল পরই সুইপ শটে বাউন্ডারি, বাংলাদেশ ২০২। অবিশ্বাস্য জয় থেকে ২৯ রান দূরে। চট্টগ্রাম টেস্টে কাইল মেয়ার্সের বীরত্বের মতোই রোমাঞ্চকর কিছু করার পথে মিরাজ। কিন্তু পরের ওভারেই আবার ওয়ারিকানের সামনে আবু জায়েদ। সিঙ্গেল নিয়ে মিরাজকে স্ট্রাইক দেওয়ার জন্য পুশ করতে গেলেই আউট হওয়ার ঝুঁকি। তাই আবু জায়েদ প্রতিটি বল ডিফেন্স করতেই দুই দলের ডাগআউট থেকে প্রেসবক্সে রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ।
৬০তম ওভার আবু জায়েদ খেলে দিতেই জোর করতালি। কে একজন কমেন্ট করেছেন, ‘একটা নিমন্ত্রণ ছিল, বাতিল করে দিলাম!’ পরের ওভারে কর্নওয়ালের শেষ তিন বলে ছক্কা, চার এবং শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে ওয়ারিকানের সামনে মিরাজ। একটা সময় অসম্ভব মনে হতে থাকা বাংলাদেশের জন্য তখন বাকি ১৮ রান তোলা আর কোনো দিবাস্বপ্ন নয়।
দারুণ চনমনে ক্যারিবীয় ডাগআউটও তখন দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তবে ওই ওভারের তৃতীয় বলেই সব দম বন্ধ করা উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে জয়ের উন্মাদনায় মেতে ওঠে সফরকারীরা। মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে স্লিপে রাকিম কর্নওয়ালের হাতে জমা পড়তেই ভোঁ দৌড় দেন জোমেল ওয়ারিকান। তাঁকে ঘিরে বিজয়োল্লাসে মত্ত ক্যারিবীয়রা। সেখান থেকে ক্যামেরা প্যান করতেই পর্দায় ভেসে ওঠে মিরাজের হৃদয়ভাঙা অভিব্যক্তি। কিছুক্ষণ তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকল ওয়ারিকানের বলটা যে স্পটে পিচ করেছিল, সেখানে। এরপর মাথা তুললেন মিরাজ রাজ্যের সবটুকু শোকবিহ্বলতাকে নিয়ে। আর মাত্র গোটা কয়েক স্কোরিং শট নিতে পারলে তো মহানায়ক হতেন তিনিই। তবু অভিবাদন মিরাজকে, বুক চিতিয়ে লড়াই করার জন্য।
চতুর্থ দিনের শুরুর লড়াইটা করেছিলেন বাংলাদেশি বোলাররা, ঝটপট ৩ উইকেট তুলে নিয়ে। আগের দিনের ৩ উইকেটে ৪১ রান করা ক্যারিবীয়রা তাই লাঞ্চে যায় ৬ উইকেটে ৯৮ রান নিয়ে। অবধারিতভাবে এ সেশনে জয়ী বাংলাদেশ। তবে সঙ্গে আরেকটি আশঙ্কাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, ড্রয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে না আবার হার ডেকে আনে বাংলাদেশ! কারণ ততক্ষণে ২১১ রানে এগিয়ে গেছে ক্যারিবীয়রা। বিরতির পর আর কিছু রান তো যোগ হবেই। সঙ্গে চতুর্থ দিনে এসে ঢাকার উইকেট স্বরূপে ফেরার যে ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে এবং বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা মিশেলে আশঙ্কার উঁকিঝুঁকি।
সফরকারীদের দ্বিতীয় ইনিংস ১১৭ রানে গুটিয়ে দেওয়ার পরও তাই বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত মনে হয়নি। এবং আশঙ্কা প্রকাশকারীদের তাঁরা হতাশও করেননি। অথচ জয়ের জন্য ২৩১ রান তাড়া করতে নেমে তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার ৫৯ রানের শুভ সূচনা উপহার দেন দলকে। অবাক হবেন না জেনে যে দুই টেস্টের চার ইনিংসে এটাই বাংলাদেশের সেরা উদ্বোধনী জুটি! কিন্তু তবু আশাবাদী হই কী করে? ক্যারিবীয়দের বোলিং শৃঙ্খলার সামনে বাংলাদেশের ‘অস্থিরমতি’ ব্যাটসম্যানদের লড়াইয়ের সমাপ্তি সুখকর হওয়ার নয়, শুভ সূচনার পরও। এ ধারা বদলায়ওনি। বিনা রানে অপরাজিত থাকা আবু জায়েদ ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সব ব্যাটসম্যানই দুই অঙ্ক ছুঁয়েছেন। কিন্তু একজন স্বীকৃত ব্যাটসম্যানকেও শেষ বাউটে সঙ্গী হিসেবে পাননি মিরাজ। একটাই ফিফটি তামিম ইকবালের। এর পরই মিরাজের ৩১। মাঝখানে বাকিরা। উদ্বোধনী জুটিটাই সবচেয়ে বেশি রানের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি মাত্র ৩২ রানের।
প্রায় সব ব্যাটসম্যানের সেট হয়েও এমন টেস্ট ইনিংস বিরল! তবে আরো বিরল প্রতিপক্ষের কোনো ইনিংসের সবগুলো উইকেট ক্যারিবীয় স্পিনারদের ভাগাভাগি করে নেওয়া। ১৯৫৬ সালে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের পর এই প্রথম এমন কীর্তি গড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ইয়ান বিশপের কাছে তাই এই অনভিজ্ঞ ক্যারিবীয় দলের প্রতিটি সদস্যই ‘জাতীয় বীর’। এমন উচ্ছ্বাসকে আতিশয্য মনে করার কোনো সুযোগ নেই। প্রশংসাসূচক যাবতীয় বিশেষণ বরাদ্দ ক্রেইগ ব্রাথওয়েটদের জন্য।
‘অভিনন্দন’ প্রবল চাপের মুখে পড়া বাংলাদেশ দলের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকেও। এমন রোমাঞ্চকর ক্রিকেটের প্রত্যাশা টেস্ট সিরিজ শুরুর আগেই করেছিলেন তিনি। যদিও গত সন্ধ্যায় বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের প্রতিক্রিয়ায় মনে হলো তিনি মমিনুল হকদের গুরুর প্রত্যাশা পূরণের সাক্ষী হয়ে মোটেও আহ্লাদিত নন!
Discussion about this post