‘আহ দারুণ! বোলাররা তাদের কাজটা করেছে। এখন ব্যাটসম্যানদের পালা।’- কিন্তু আদতে জ্যাক ক্যালিস কথাটা বলেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসে এক ওয়ানডেতে দলীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি রান হজম করার পর। তিনি নিজে দিয়েছিলেন ছয় ওভারে ৭০ রান। তেড়েফুঁড়ে গিয়ে সতীর্থরা যে কিছু বলে বসেননি সেটাই তো অনেক! সেই ‘অনেক’-এর অনেক কিছু বাকি ছিল যে সেদিন!
এর আগে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করার রেকর্ড ছিল ৩৩২ রানের। এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই! তাই বলে ৪৩৪ রান তাড়া করে ফেলার আশাটা বাড়াবাড়িই ছিল। অন্তত টি-টোয়েন্টি যখন ডালপালা মেলেনি, সে যুগে তো বটেই! ভাগ্যিস প্রোটিয়ারা সে আশাটা করেছিল!
ঘণ্টা দশেক আগে। সারারাত টিম হোটেলের বাইরে। আমোদ-ফুর্তি করে বেরিয়ে ভোর রাতে ফিরলেন দক্ষিণ আফ্রিকান এক ক্রিকেটার। এমন অবিমৃষ্যকারিতার ফলে ঘুমের চোটে আরেকটু হলে টিম বাসটাও মিস করতে বসেছিলেন হার্শেল গিবস। কোচ মিকি আর্থার আর টিম ম্যানেজমেন্ট অবশ্য ব্যাপারটাকে দেখেছিলেন ‘ক্ষমাসুন্দর’ দৃষ্টিতেই।
জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে অবশ্য শুরুটা অতো কিছুর আভাস দেয়নি। ২-২ সমতায় থাকা সিরিজের অঘোষিত ফাইনালে পাটা উইকেট দেখে অধিনায়ক পন্টিং টসে জিতে বেছে নিয়েছিলেন ব্যাটিং। তার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর সাইমন ক্যাটিচ ১০০ রান তুলেছিলেন ১৭ ওভারে। এরপর গিলক্রিস্ট গেলেন, দল অবশ্য ১৫০ তুলে নিল ২৪ ওভারেই। কিন্তু এ তো ওয়ানডের হরহামেশা চিত্রই!
পরিস্থিতি বদলাতে থাকল পন্টিং মাঠে আসার পর। অস্ট্রেলিয়া দু’শো ছোঁয় ২৯ ওভারে, ৩৪ ওভারে ২৫০ আর পরের পাঁচ ওভারে ৩০০! ওয়ানডের প্রথম চারশ তখন দারুণভাবে দৃষ্টিসীমায়।
শ্রীলঙ্কা ১৯৯৮ সালে থেমেছিল ৩৯৮ রানে। এর আগের বছরই ইংল্যান্ড ৩৯২ আর নিউজিল্যান্ড ৩৯৭-এ গিয়ে আটকে গিয়েছিল, ৪০০ আর ছোঁয়া হয়নি। সেই ক্ষয়রোগের ভয় থেকেই কিনা ৪৭ ওভারে যখন আউট হলেন মাইক হাসি, কোচ জন বুকানন ডেমিয়েন মার্টিনের জায়গায় পাঠালেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে। ৪০০ হলো সে ওভারেই। দুটো ওয়ানডে আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৯৩ রানে অলআউট হওয়া অজিরা থামল ৪৩৪-এ। এমন এক সংগ্রহ, এতদিন যার কেবল কল্পনাই করতে পেরেছে ক্রিকেট!
কিন্তু সেদিন ভিন্ন কিছুই তোলা ছিল! এরপরই অধিনায়ক গ্র্যায়েম স্মিথ আর গিবসের পাল্টা হামলা। দুজনে মিলে পরের ২১ ওভারে তুললেন ১৮৭ রান। খণ্ডকালীন স্পিনার মাইকেল ক্লার্কের বলে লং অনে মাইক হাসির হাতে ক্যাচ দিয়ে যখন ফিরছেন স্মিথ, নামের পাশে যোগ হয়েছে ৯০ রান, মহামূল্য মোমেন্টামটা তখন দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে পড়েছে হেলে।
এতক্ষণ কিছুটা খোলসে ঢুকে ছিলেন গিবস। রূদ্রমূর্তি ধারণ করলেন স্মিথ ফেরার পর। তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০০ ছুঁয়ে ফেলল ৩৩ ওভারে। তার আগে অবশ্য এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে গিবসের অমূল্য উইকেটটা হারিয়ে বসেছে স্বাগতিকরা। ১১১ বলে করলেন ১৭৫ রান, ক্যারিয়ারসেরা ইনিংসটা শেষ করে যখন ফিরছেন গিবস, অসম্ভবকে সম্ভব করার নেশা ততক্ষণে পেয়ে বসেছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ১০০ বলে চাই আর ১৩৫ রান, ছয় উইকেট আছে হাতে; সেদিনের জোহানেসবার্গের বাস্তবতায় লক্ষ্যটা খুব বেশি ছিল না আদৌ।
চোটের কারণে এদিন দলে ছিলেন না গ্লেন ম্যাকগ্রা। এতোক্ষণ তার অনুপস্থিতিটা টের পেলেও এর পরের পাঁচ ওভারে সেটা ভুলিয়ে দেওয়ার যোগাড়যন্ত্রই করে বসেন অজি বোলাররা। সাইমন্ডস তুলে নেন প্রধান ভরসা জ্যাক ক্যালিসকে আর জাস্টিন কেম্প শিকার হন ব্র্যাকেনের।
এরপর মার্ক বাউচার একপাশ আগলে রাখলেও অন্যপাশে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন রজার টেলিমেকাস ফিরলেন সাজঘরে, তখনো ২ বলে আরো দুই রান চাই দক্ষিণ আফ্রিকার। শেষ পর্যন্ত ভরসাটা গিয়ে ঠেকে মাখায়া এনটিনিতে, দলে মূল কাজ যার বোলিং, ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন পড়ে কালেভদ্রে।
সেই ‘কালেভদ্রে’ প্রয়োজনটাই সেদিন এসে পড়ে এনটিনির কাছে। পঞ্চাশতম ওভারের পঞ্চম বলটা থার্ডম্যানে ঠেলে দিয়ে সেটা মেটালেন তিনি। পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অমূল্য রানও ছিল সেটি। অমূল্য হবেই বা না কেন, মিড অনের ওপর দিয়ে বাউচারের চারটা যে এনে দিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় জয়টি এনে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে!
টি-টোয়েন্টি তখনো রমরমা হয়ে ওঠেনি, দ্রুত রান করার অভ্যেস তো বটেই আরো অনেক চলও নিয়মিত হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তারই একটা ডাগআউট প্রথা। বাউচারের মারা চারটার পরই গ্র্যায়েম স্মিথ অনেকটা ছিটকে বেরোলেন ড্রেসিং রুমের জানালা দিয়ে। ৩৪ হাজার দর্শকের গর্জনে ওয়ান্ডারার্সে কান পাতা দায়!
ম্যাচসেরা হলেন গিবস, দল কর্তৃপক্ষ একটু কঠোর হলে যার খেলাই হতো না ম্যাচটা। তবে আনুষ্ঠানিক নায়ক গিবস হলেও, অনানুষ্ঠানিকভাবে পুরো দলটাকেই চাইলে ম্যাচসেরা ঘোষণা দিয়ে দেওয়া যেত। মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে ৪০০ রান হজম করে সেটা টপকে যাওয়াটা চাট্টিখানি কোনো ব্যাপার যে নয়!
এর আগে কখনো ৪০০’র দেখা না পাওয়া ক্রিকেট সেদিন তিন ঘণ্টার ব্যবধানে দেখেছে দুটো চারশো ছাড়ানো ইনিংস। এরপর প্রোটিয়াদের এ রানের রেকর্ড ভেঙেছে আরো তিনবার। তবে ১৫ বছর আগের আজকের এ দিনটার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি আর কখনো।
Discussion about this post