স্বপ্ন চান্দা
অতীত উদাহরণ দিতে গেলে তো আর শেষ হবে না। তাই একেবারে সাম্প্রতিকেই থাকি। লারা-টেন্ডুলকার থেকে ফেদেরার-নাদাল। অধিষ্ঠিত রাজাকে সরিয়ে যুবরাজের অভিষেক করার ব্যাপারটা কোনো খেলাতেই নতুন না। ফুটবলে অসংখ্য নতুন ‘পেলে-ম্যারাডোনার’ ঝলক দেখে শেষমেশ পাওয়া গেছে মেসি ও রোনালদোকে। তাঁদের উত্তরসূরিও তো কম পাওয়া গেল না। নতুন মেসি-রোনালদোর আর দেখা মিলল কই! কখনো সে আশা করাটাই ছিল বাড়াবাড়ি, কখনো বা কারও সামর্থ্য থাকলেও ঠিক কাজে লাগাতে পারেননি, হয়তো প্রত্যাশার ভারেই। এই উচ্চতা ছুঁতে যে শারীরিক দিকটার সাথে মানসিক ব্যাপারটাও জড়িয়ে। সবকিছু মিলিয়ে নতুন মেসি-রোনালদো হেডিং দেখলেও কেউ ফিরে তাকায় না আর। কিন্তু নামটি যদি হয় কিলিয়ান এমবাপ্পে বা এরলিং হ্যাল্যান্ড, তা বোধহয় দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে বাধ্য করবে।
লিগ ওয়ানের গত নয় বছরের রোল অব অনারে মোনাকো একমাত্র পিএসজি-ভিন্ন নাম। যে টিমে ফ্যালকাও-সিলভা-ফ্যাবিনহোদের সঙ্গে ছিল ১৭ বছরের এমবাপ্পেও। থাকাটা শুধু নামে না, ১৫ গোলের সাথে ছিল ৮ অ্যাসিস্টও। লিগ জিতেছেন আরও তিনবার, সঙ্গে দুটো ফ্রেঞ্চ কাপও। যার সবই পিএসজির হয়ে। এটা যদি আপনার বলার মতো কিছু মনে না হয়, দেশের বাইরেই না হয় যাওয়া যাক।
ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ? নিঃসন্দেহে ক্লাব পর্যায়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বকাপ। সে দুই মঞ্চেই কী ওড়েনি এই নতুনের কেতন? সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছেন ফাইনাল এবং সেটা যে শেষবারের মতো নয়, তা তো বলেই দেওয়া যায়। ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের এই ট্রফি জিততে বাকি ক্যারিয়ার বাড়তি অনুপ্রেরণা কাজ করবে অবশ্যই। মোটামুটি বাকিসব কিছু জেতা হয়ে গেছে যে। রেকর্ড চুরমার করে দিয়ে বিশ্বকাপটাও।
১৫-২০ বছর ধরে ফুটবল খেলেও বিশ্বকাপ অধরা থেকে গেছে ফুটবলের অনেক গ্রেটদের। বাকেট লিস্টে যে ইচ্ছা পূরণের টিক এমবাপ্পে দিয়ে ফেলেছেন ১৯ বছর বয়সেই, তা আবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। আর্জেন্টিনার সাথে যার প্রদর্শনী চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেয় এখনও। পেলের পর একমাত্র টিনেজার হিসেবে করেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল। পেলের পদচারণই যদি হয় পাথেয়, ফ্রান্সের সোনালি প্রজন্মের সাথে হয়তো জেতা হবে একাধিক বিশ্বকাপও। এরলিং হ্যালান্ডের ক্ষেত্রে আবার সে আশা করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।
নরওয়েজিয়ান হলেও হ্যালান্ডের মধ্যে প্রথাগত স্ক্যান্ডানেভিয়ানের ছাপ খুঁজে পাওয়া দায়। আইডল যার জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, তার কাছে অমনটা আশা করাই অন্যায়। রাতারাতিই ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে মূল চরিত্রের পদপ্রার্থী তিনি। ফুটবলটা তো দিনশেষে গোলের খেলা। এত সব সিস্টেম, ট্যাকটিকসের কচকচানি সবকিছুরই উদ্দেশ্য তো একটাই – শেষে যেন বলটা জড়ায় প্রতিপক্ষের জালে। সে কঠিন কাজটাই যখন হেসেখেলে করতে থাকেন এক ১৮ বছরের সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণ, গোল হতে থাকে মুড়িমুড়কির মতো, আলোচনা তো হবেই।
অবশ্য ফিজিক্যালিটির দিক থেকে এই ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্ট্রাইকারকে দেখে বোঝা কঠিন, বয়সটা তার সবে ২০। বরাবরই নিজ বয়সীদের তুলনায় আগানো হ্যালান্ডকে যে সমবয়সীদের ছেড়ে খেলতে হয়েছে ‘বুড়োদের’ সাথে। বয়স যখন মাত্র সাত, তখনই তা জানা হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলার কোচ বারন্সটেনের। মাঝেমধ্যেই বারন্সটেনদের সাথে শারীরিক যুদ্ধে দাঁড়াতে না পারায় বুদ্ধি খাঁটিয়ে বের করতে হয়েছে অন্য রাস্তা। পজিশনিং সেন্সটাও রক্তের সাথে মিশে গেছে তখন থেকে। মঞ্চটা বদলালেও সেই ডিএনএ তো বদলানোর নয়।
সালসবুর্গের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিষেক। অভিষেকেই হ্যাটট্রিক। যেটা সালসবুর্গ না হয়ে হতে পারতো রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা কিংবা বায়ার্নের হয়ে। খেলার ধরন তার প্রথাগত নয়। আনঅর্থোডক্স যাকে বলে। যাতে গ্রেস্ফুল কেশরদুলানো ঘোড়ার থেকে রোবটের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বেশি। কার্যকরী, কিন্তু চোখের আরাম নেই। আর ফিজিক্যালিটির ব্যাপারটা তো আছেই। প্রতিভাবান তো কতজনই, সেই প্রতিভাকে পরিণতি দিতে পারে আর কজন! ১৬-১৭ বছরের কারো নামের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকায় অনেক বড় ক্লাবই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সাহস করেনি আর। শেষে ঠিকানা সালসবুর্গ।
সেখান থেকেই শুরু রেকর্ড ভাঙার খেলার। চ্যাম্পিয়নস লিগে ১০ গোল করতে লেগেছে মাত্র ৭ ম্যাচ। যা ৬৬ বছর পুরনো এই ক্লাব প্রতিযোগিতার ইতিহাসে দ্রুততম। করেছেন প্রথম টিনেজার হিসেবে এক সিজনে ১০ গোল করার প্রথম কীর্তিও। শুরু্র বিদ্যুৎচ্চমকের পর হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণও তো কম নেই। এঁদের নিয়ে তাহলে এত হইচইয়ের কী আছে?
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলাতে থাকে খেলার ধরণ। একসময়ের স্টেপল ফরমেশন ৪-৪-২ এখন দেখাই যায় না আর। সাম্প্রতিক সময়ে উরুগুয়েই একমাত্র দল যারা নিয়মিত খেলিয়েছে দুই স্ট্রাইকার। যে দুই স্ট্রাইকারের একজন থাকে সাপোর্টিং রোলে, যার কাজ মুলত ‘হোল্ডিং আপ প্লে’। যে প্রজাতির স্ট্রাইকার এখন বিলুপ্তপ্রায়, বর্তমান সিস্টেমগুলোতে বেমানানও। কিলিয়ান এমবাপ্পে ও এরলিং হ্যালান্ড যে সিস্টেমে পারফেক্ট ফরওয়ার্ড। স্ট্রাইকার না বলে ফরওয়ার্ড বলাই ভালো।
পেপ-ক্লপ-হেইঙ্কেন্সের ৪-৩-৩-ই সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ইদানিং। আধুনিক ফরওয়ার্ডকে দেখা যায় সামনের তিন পজিশনেই। কখনো মাঝে, কখনো ইনভার্টেড উইঙ্গার হয়ে। পিএসজিতে যা নেইমারের সাথে করে আসছেন এমবাপ্পে অনেকদিন ধরেই। ইনভার্টেড উইঙ্গাররা কাট-ইন করলে ওভারল্যাপে উঠে উইং ব্যাকরা, ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা যেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে এসে আলাদা হয়ে যায় অভিজ্ঞ আর অনভিজ্ঞরা। এখানে অবশ্য এমবাপ্পে ও হ্যালান্ডকে অন্যতম বিশ্বসেরা বলে দেওয়া যায় এখনই, কোনো বয়সের এস্টেরিস্ক ছাড়াই।
পরিসংখ্যানও তাদের হয়েই কথা বলে। এই ২০ বছর বয়সেই ডর্টমুণ্ডের হয়ে হ্যালান্ডের রেকর্ড প্রায় অতিপ্রাকৃত। ম্যাচের থেকে বেশি গোল – ৪১ ম্যাচে ৪২টি। যে মেসি-রোনালদোর কল্যাণে এমন পরিসংখ্যান দেখে অভ্যস্ত, সে ‘অমানুষেরাও’ তো তা করেনি ২২-২৩ বছরে পা দেওয়ার আগে। ২১ বছর বয়সের আগে তাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ গোলের রেকর্ডটা এমন – এমবাপ্পে (১৯), হ্যালান্ড (১৮), মেসি (৮), রোনালদো (০)। ২০১৯-২০ ইউসিএল শুরুর পর থেকে যেখানে মেসি-রোনালদোর মোট গোল ১৫, তাদের দুজনের প্রায় তার দ্বিগুণ – ২৮।
হঠাৎ জোরেশোরে দুই প্রজন্মের তুলনা শুরু হওয়ার কারণ চ্যাম্পিয়নস লিগ রাউন্ড অব ১৬ এর প্রথম সপ্তাহের চিত্রনাট্য। ক্যাম্প ন্যুতে বার্সাকে একরকম নাচিয়ে ফেলে এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক। পরদিন সেভিয়ার সাথে হ্যালান্ডের জবাব ২ গোলে। পারফরমেন্স দুটিকে মিলিয়ে ফেলার ব্যাপারটা দর্শকের মনগড়া নয়। পোস্টম্যাচ ইন্টারভিউতে হ্যালান্ড নিজেই বলেন, আগের রাতে দেখা এমবাপ্পে হ্যাটট্রিকই ছিল তার অনুপ্রেরণা। রোমান্টিক মন যে তা মিলাতে চায় মেসি-রোনালদোর গোলের জবাব গোলে দেওয়ার দিনগুলোর সাথে!
এটা কি তাহলে নতুন এক দ্বৈরথের শুরু?
।
Discussion about this post