সালেম মাশরুর চয়ন
ঐতিহাসিকভাবেই টেনিস খেলাটাতে এশিয়ান মেয়েদের তেমন কোনো ইতিহাস ছিল না। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সেরেনা আর ভেনাস উইলিয়ামস যখন ফ্রেঞ্চ ওপেনের ডাবল জিতে প্রথম বড় কোনো শিরোপা জেতার উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন, টিভি পর্দায় সে দৃশ্য অনুপ্রাণিত করেছিল জাপানের এক বাবাকে। নিজের দুই মেয়ে নাওমি আর মারি ওসাকাকে নিয়ে সেদিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন টেনিস জগতে আরেকটা সেরেনা ভেনাসের যুগ সৃষ্টি করার। তার সেই স্বপ্নের উপর দাঁড়িয়ে আজ এটিপি র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে তার ছোট মেয়ে নাওমি ওসাকা, যাকে নিয়ে আজকে আমাদের এই গল্প বলার আসর।
মা বাবার অমতে বাসা থেকে পালিয়ে আসা এক জাপানি মা আর হাইতিয়ান বাবার ঘরে জন্ম নাওমির। সেই হাইতিয়ান বাবা লিওনার্ডো ফ্রাঙ্কোইসের টেনিসের জগতে নতুন সেরেনা আর ভেনাস তুলে আনার স্বপ্ন তিন বছর বয়সে ২০০০ সালে নিয়ে আসে তাদের আমেরিকায়। উইলিয়ামস বোনদের বাবা রিচার্ড উইলিয়ামসকে অনুসরণ করে পুরো আমেরিকা ঘুরে ঘুরে দুই মেয়েকে টেনিসের ট্রেনিং দিয়ে বেড়িয়েছেন লিওনার্ডো। কিন্তু স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ভুল করে প্রতিভা চিনতে। নাওমির ছোট বয়সে তার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায় না আমেরিকার টেনিস অ্যাসোসিয়েশন। তাই নাওমিকে জন্মভূমি জাপানের হয়েই খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন তার বাবা, পরবর্তীতে আমেরিকা আগ্রহ দেখালেও যে সিদ্ধান্ত বদল হয়নি আর।
আইটিএফ-এর জুনিয়র লেভেলে তেমন একটা সাফল্য পাননি নাওমি। সাতবারের চেষ্টায় এককে কোয়ালিফাই করা আর বোন মারির সাথে দ্বৈতে খেলা নাওমি কোনো ট্রফিই জিততে পারেননি জুনিয়র পর্যায়ে। তবে পৃথিবীকে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়ার কাজটা করতে বেশিদিন অপেক্ষা করেননি তিনি। ২০১৪ সালে প্রথমবারে মতো স্ট্যানফোর্ড ক্লাসিকে সুযোগ পেয়ে টানটান উত্তেজনার এক ম্যাচে তৎকালীন বিশ্বের উনিশ নম্বর খেলোয়াড় সামান্তা স্টোসুরকে হারিয়ে মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলে দেন তিনি। পরের বছর উইম্বলডন আর ইউএস ওপেনের বাছাইয়ে চেষ্টা করেও মূল পর্বে টিকতে পারেননি নাওমি। অবশেষে ২০১৬ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের স্বাদ পান তিনি, হারিয়ে দেন ২১তম বাছাই এলিনা সভিতোলিনাকে। কিন্তু স্বপ্নযাত্রা ভাঙে তৃতীয় রাউন্ডেই, বিদায় নেনে ১৬তম বাছাই ভিক্টোরিয়া আজারেংকার কাছে হেরে। এরপর একটা ছোট্ট ইনজুরিতে জুলাই পর্যন্ত বিরতি নিলেও ফিরে আসেন প্যান প্যাসিফিক ওপেনে আর সবাইকে তাক লাগিয়ে উঠে যান ফাইনালে। সেখানে ক্যারোলিন ওজনিয়াকির কাছে হেরে রানার্সআপ হলেও বছর শেষে বিশ্ব টেনিস সংস্থার থেকে বছরের সেরা উঠতি খেলোয়াড়ের সংবর্ধনা পান নাওমি।
কিন্তু ২০১৭ টা বেশ বাজেই কাটে নাওমির। উইম্বলডনের শক্ত কোর্টের খেলায় প্রথম রাউন্ডে অ্যাঞ্জেলিকা কারাবারকে হারালেও সারা বছরই মাটির আর ঘাসের কোর্টে বেশ হাঁসফাঁসই করতে হয় তাকে। তাই ২০১৮ এর শুরুতে নিয়োগ দেন নতুন কোচ সাচা বেজিনকে। আর ফলাফল আসে হাতেনাতেই। ক্যারোলিনা পিসকোভা আর তৎকালীন নাম্বার ওয়ান সিমোনা হালেপকে হারিয়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জিতে নেন ইন্ডিয়া ওয়েলস ওপেন। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলতে থাকা নাওমি নিজের প্রথম ট্রফি জয়ের পথে শুধুমাত্র একটা সেটেই হেরেছিলেন। ফর্মের তুঙ্গে থেকে মায়ামি ওপেনের প্রথম রাউন্ডে হারিয়ে দেন নিজের ছোটবেলার আদর্শ আর মাত্রই সন্তানের জন্ম দিয়ে আসা সেরেনা উইলিয়ামসকে। তারপর কিছুটা ট্রফির খরা গেলেও টেনিস বিশ্বে নাওমি ঝড় শুরু হয় ২০১৮ এর শেষের দিকে ইউএস ওপেন দিয়ে। প্রথম জাপানিজ নারী হিসেবে কোনো গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনালে উঠে প্রথম জাপানিজ নারী হিসেবে গ্র্যান্ড স্লামটাও জিতে নেন নাওমি ওসাকা, তাও সেই আদর্শ মেনে বড় হওয়া সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়েই। এ যেন রুপকথাকেও হার মানায়।
প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক খেলা দিয়ে নাওমি ওসাকা ধীরে ধীরে সবার মনে ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। ১৬ বছর বয়সেই ১৬০ কিলোমিটার/ঘণ্টায় সার্ভ করতে পারা নাওমি পরবর্তীতে গতি বাড়িয়েছেন ২০০ পর্যন্ত। তবে তার ব্যবধান গড়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল লম্বা র্যালিগুলো জিততে পারার শক্তি আর স্ট্যামিনায়। ২০১৯ এর প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও জিততে রেকর্ড বইয়ে একটা ছোটোখাটো ঝড় বইয়ে দেন নাওমি। ২০১৫ সালের সেরেনা উইলিয়ামসের পর প্রথম নারী হিসেবে পরপর দুই গ্র্যান্ড স্লাম জেতার পাশাপাশি ২০০১ সালের পর প্রথম নারী হিসেবে প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের পরপরই পরের গ্র্যান্ড স্লামও জেতার রেকর্ড করেন। ওদিকে রেকর্ড বইয়ের পাতা উল্টে প্রথম এশিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে র্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠে যান নাওমি।
সাফল্যের এই শীর্ষে থাকা অবস্থায়ই কোচ সাচা বেজিনকে বরখাস্ত করেন নাওমি। কিন্তু এবারের কোচ বদল খুব একটা কাজে দেয় না। তাই ইউএস ওপেনে নিজের শিরোপা বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ার পর ছোটবেলার প্রথম কোচ বাবা লিওনার্ডোর কাছে ফিরে যান নাওমি। বাবার স্পর্শে আবার ফর্ম ফিরে পান তিনি, যেতেন পরপর দুইটি শিরোপা। এরপর আসে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ। পুরো দুনিয়ার মতো স্তব্ধ হয়ে যায় টেনিসের মাঠও। তবে সিনসিনাটি ওপেন দিয়ে যখন খেলায় ফেরেন নাওমি, যেন যেখানে শেষ করেছিলেন শুরু করেন সেখান থেকেই। সিনসিনাটি ওপেন জিতে একটানে জিতে নেনে ইউ এস ওপেন আর ২০২১ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও। রজার ফেদেরার আর মনিকা সেলেসের পর ইতিহাসের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ৪টি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলে ৪টিই জেতার রেকর্ড করেন নাওমি ওসাকা, দখল করেন র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান।
তবে করোনার পরের নাওমি শুধু একজন অসাধারণ টেনিস খেলোয়াড় হিসেবেই খবরের শিরোনাম হননি। আমেরিকায় পুলিশ নির্যাতনে জ্যাকব ব্ল্যাকের মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে ওঠা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের তিনি ছিলেন একজন সোচ্চার সৈনিক। সিনসিনাটি ওপেনের সেমি ফাইনালের আগে আন্দোলনের সমর্থনে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নাওমি, পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ তার সমর্থনে এসে একদিনের খেলা পিছিয়ে দিলে তবেই ফিরে আসেন তিনি। ইউএস ওপেনের সাত ম্যাচে সাতটি কালো রংয়ের মাস্ক পড়ে এসেছিলেন তিনি, প্রত্যেকটিতে ছিল একেকজন নিপীড়িত আফ্রিকান আমেরিকানের গল্প। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর যুদ্ধ তিনি নিয়ে এসেছিলেন টেনিসের ময়দানে।
খুবই রক্ষণশীল জাপানিজ ঘর থেকে উঠে আসা নাওমি পরিবারের সবার সমর্থন পাননি কখনোই। সামান্থা স্টোসুরের সাথে অঘটনের আগে তার নানা নানী মোটেও মেনে নেননি তার বাবার সেরেনা ভেনাস বানানোর অভিযান। স্বভাবগতভাবে লাজুক নিজের লজ্জাকেও জয় করেছেন এই বর্ণবাদের যুদ্ধে। টেনিসের ময়দানে এভাবেই এশিয়ার পতাকা হাতে হাসিমুখে যুদ্ধ করে যাবেন এই হার না মানা নারী, এই আমাদের প্রত্যাশা।
Discussion about this post