আযমাইন রাফিন
অলিম্পিকের সবচেয়ে লজ্জার রেকর্ডটা বাংলাদেশের।কখনো কোন পদক না জেতা সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ আমরা। ফুটবলেও আমাদের অবস্থা সুবিধার না, বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ের নিচের দিক থেকে খোঁজা শুরু করলে সহজে দেখা মেলে আমাদের। হকি-ভলিবল-হ্যান্ডবল-বাস্কেটবলে আন্তর্জাতিক মানের আশেপাশেও আমরা নেই, গলফ-আর্চারি ব্যক্তিগত কিছু ঝলক দেখালেও সামগ্রিকভাবে ফলাফল শূন্যের কাছাকাছি।
এত এত হতাশার ভিড়েও ছোট্ট একটা আশার প্রদীপ টিম টিম করে জ্বলতে থাকে আমাদের ভাঙা কুঁড়েঘরে। ক্রিকেট। জানি, বিশ্বের বেশি সংখ্যক দেশ ক্রিকেট খেলে না, যে কয়েকটি হাতে গোণা দল খেলে তাদের মধ্যেও আমাদের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে নয়, কিন্তু তবুও, কোন খেলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে ঐ ক্রিকেটই আমাদের ভরসা। প্রিয় পাঠক বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়েই আজকের গল্প। তাহলে চলুন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম দিকের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।
স্বাধীনতার আগে বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার কয়েকজন ক্রিকেটার পাকিস্তান দলে সুযোগ পেলেও দল হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) গঠনের পর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্যে পরিণত হয়, ১৯৭৯ সালে অংশগ্রহণ করে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে। এই টুর্নামেন্টের ম্যাচগুলো অবশ্য আন্তর্জাতিক ম্যাচের মর্যাদা পায়নি। এসব শুষ্ক ইতিহাস পড়তে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়, তার চেয়ে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের দিকে তাকানো যাক।
১৯৮৬ সাল।
এশিয়া কাপের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়ায় পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামে বাংলাদেশ, বলা বাহুল্য ওয়ানডে ম্যাচ। বাংলাদেশের হয়ে টস করতে গিয়েছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, এই প্রজন্ম অবশ্য বিসিবির সাবেক পরিচালক হিসেবেই তাঁকে বেশি চিনবে। যাই হোক, সেই ম্যাচের গল্পে ফিরি। প্রথম ম্যাচের সেই টস নিয়ে বেশ রসালো একটা গল্প প্রচলিত আছে। পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খান নাকি টসের জন্য পিচের মাঝখানে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা বাংলাদেশের জন্য যা ছিল অপমানজনক ইত্যাদি ইত্যাদি। গাজী আশরাফ হোসেন লিপু অবশ্য এসব অস্বীকার করেন, যেভাবে গল্পটা ব্যাখ্যা করা হয়, ততটা তীব্রতা নাকি ছিল না আসল ঘটনার। সেসময়ের টস হতো একেবারেই অনানুষ্ঠানিকভাবে। এখনকার মতো টেলিভিশন ক্যামেরা-ক্রু তো দূরের কথা, তখন ম্যাচ রেফারিও থাকতেন না টসের সময়ে। দুই অধিনায়ক নিজেদের মতো টস করে ফলাফলটা শুধু ম্যাচ রেফারিকে জানাতেন। ইমরান খান তাই প্রস্তাব করেছিলেন মাঠের মাঝ পর্যন্ত না গিয়ে বাউন্ডারির বাইরেই টসটা সেরে ফেলার জন্য।
যা হোক, আলোচিত সেই টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পাকিস্তান। অনুমিতভাবেই বাংলাদেশের ব্যাটিং ভালো হয়নি। চারে নামা শহীদুর রহমানের ৩৭-ই ছিল সর্বোচ্চ। ব্যক্তিগত কোন ফিফটি নেই, দলও পেরোতে পারেনি ১০০ রানের মাইলফলক। মাত্র ৯৪ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতে প্রথম জয় পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ১২ বছর! অনেক সময় মনে হচ্ছে? জেনে রাখুন, এই ১২ বছরে মাত্র ২২টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। ২৩তম ম্যাচে ছিন্ন হয়েছিল হারের ধারা, প্রতিপক্ষ কেনিয়া।
হ্যাঁ, কেনিয়া। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে-পরের সময়গুলোতে কেনিয়াই ছিল আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্যান্য দেশের কথা বাদই দিলাম, জিম্বাবুয়েও তখন মহাশক্তিধর প্রতিপক্ষ। আমাদের আনন্দের উপলক্ষ তাই আসতো কালেভদ্রে। ’৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অঘটনের জয়ের পর টানা ৪৭ ম্যাচ আমরা জয়বঞ্চিত হয়েছিলাম। ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়টা তাই কতটা আনন্দের ছিল, এ প্রজন্ম সেটা কীভাবে বুঝবে!
তবে যে যাই বলুক, তখন আমরা ছিলাম ‘মিনোস’। ২০০৪ এ ভারত আর পরের বছর অস্ট্রেলিয়া-বধের গল্পটা তাই অঘটনই ছিল নির্দ্বিধায়। ‘আমরা পারি’ এই মনোভাবের সূচনা আসলে ২০০৭ এর বিশ্বকাপে। ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেই যে বিশ্বকাপে বড় মাছ শিকারের রীতি শুরু করলাম, এরপর মোটামুটি প্রতি বিশ্বকাপেই সেই ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি।
বিশ্বকাপের ঐ বিস্ময়কর সাফল্যের সাথে সাথে আমরা পেয়েছিলাম কয়েকজন উঠতি যুবক, যাঁদের চোখেমুখে ছিল সাফল্যের ক্ষুধা। পেস বোলিংয়ে মাশরাফি তো বটেই, তিন তরুণ ব্যাটসম্যান সাকিব-তামিম-মুশফিক দিয়েছিলেন অনেক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে আরো কয়েক বছর লেগে গেলো। মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সাফল্য, কিছু সিরিজ জয় এলেও দল হিসেবে পারফর্ম করা শুরু করলাম ২০১২ সালে। সেই এশিয়া কাপ!
টানা চার ম্যাচে তামিমের পঞ্চাশ, সাকিবের টুর্নামেন্টসেরা পারফরম্যান্স, মাশরাফি-নাজমুলের চমৎকার বোলিং, নাসিরের দুর্দান্ত ফিনিশিং আর ভারতের বিপক্ষে জয় নিশ্চিতের পর অধিনায়ক মুশফিকের অমলিন হাসি, শেষ পর্যন্ত ফাইনালে দুই রানে পরাজয়ের পরও যা নতুন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে।
‘নতুন বাংলাদেশ’!
আমাদের দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের যে এই শব্দগুচ্ছটা কতবার লিখতে হয়েছে তার হিসাব নেই। ঘরের মাঠে উইন্ডিজ-নিউজিল্যান্ড বধের পরে লেখা হয়েছে, পুরো ‘১৪ সালে ভয়ঙ্কর রকমের বাজে পারফরম্যান্সের পর মাশরাফির নেতৃত্বে ’১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গেলে লিখতে হয়েছে, পাকিস্তান-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারালে লিখতে হয়েছে।
একদিবসী ক্রিকেটের গল্পই বলে যাচ্ছি, টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছি। আসলে টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিতে আমাদের সাফল্য খুবই কম, মাঝেমধ্যে ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে বড় দলের বিপক্ষে দু-একটা ম্যাচ জিততে পারি, অন্যথায় বড় ব্যবধানে পরাজয়ই আমাদের নিত্যসঙ্গী। ওয়ানডেতেও যে অবস্থা খুব ভালো তা নয়, তবে টেস্ট বা টি-টোয়েন্টির তুলনায় ভালো। ওয়ানডেতে দেশের মাটিতে আমরা নিঃসন্দেহে পরাশক্তি, ’১৫ বিশ্বকাপের পর ঘরের মাটিতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ হেরেছি শুধু ইংল্যান্ডের কাছে। বিদেশে অবশ্য জিততে কষ্ট করতে হয় এখনো, সেই দুর্বলতা কাটানোর লক্ষণ অবশ্য এখনো দেখা যাচ্ছে না।
হাহ, দুর্বলতা!
আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা অবশ্যই আমাদের মাঠের ক্রিকেট নয়, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমাদের ক্রিকেট বোর্ড। সত্যি কথা বলতে, বিসিবির অপেশাদারিত্ব আর উদ্ভট কর্মকাণ্ডের অনেকাংশই চাপা পড়ে যায় আমাদের মাঠের সাফল্যের কারণে। বিসিবি কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক অদক্ষতা আর অনিয়মগুলোর ফলাফল আরো গুরুতর হতে পারতো, কিন্তু সেগুলো চাপা পড়ে যায় গণমাধ্যম আর জনগণের নজর ক্রিকেটারদের ওপরে থাকায়। দলীয় সাফল্য-ব্যর্থতাগুলোর ওপর এত বেশি মনোযোগ সবার, বিসিবিতে চলমান অনিয়ম দেখার সময় কোথায়!
দলীয় সাফল্যের কথা বলছিলাম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের দলীয় সাফল্য খুব বেশি নয়, বিশ্বকাপ-চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তো দূরের কথা, একটা এশিয়া কাপও জিততে পারেনি এখনো। ‘পুরুষ’ শব্দটি বিশেষভাবে বললাম, কারণ নারীরা ইতিমধ্যে জিতেছে এশিয়া কাপ, অন্তত জাতিকে একটা শিরোপা উপহার দিয়েছেন তাঁরা।
না, ভুল বললাম। আরো একটা শিরোপা আছে আমাদের। সেটা অবশ্য জাতীয় দল উপহার দেয়নি, দিয়েছে আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দল। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, গত বছর বিশ্বকাপ জিতেছে আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দল। শুধু বিশ্বকাপ জেতেনি, একটা অমিত সম্ভাবনার ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখাচ্ছে আমাদের। জাতীয় দল কখনো কোন বড় শিরোপা জেতেনি, মাঠের ক্রিকেটেও খারাপ সময় যাচ্ছে, তাতে কী! আমাদের কাগজে-কলমে সর্বকালের সেরা প্রজন্মের তো এখনো অভিষেকই হয়নি! বয়সভিত্তিক দলে যাঁরা বিশ্বসেরা, জাতীয় দলে এসেও তো তাঁদের বিশ্বসেরা হওয়া উচিত। বিসিবি পারবে না এটুকু দায়িত্ব নিতে?
হাবিবুল বাশার বা মাশরাফি-সাকিবরা না পারলেন, আকবর আলীরা পারবেন না বিশ্বসেরার ট্রফিতে বাংলাদেশের পতাকা আঁকতে?
আমাদের অনেক স্বপ্নের এই ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে, তারিখটা ছিল ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ।
৩৫তম বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি এক বুক ভালোবাসা আর এক সমুদ্র শুভকামনা।
Discussion about this post