আযমাইন রাফিন
মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ওয়ানডে অভিষেক, অভিষেকেই ভারতের ব্যাটিং লাইন ধসিয়ে দিয়ে পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি, একেকটি উইকেট প্রাপ্তির পর প্রাণখোলা উদযাপন… পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কার কথা বলছি। না, মোস্তাফিজুর রহমান নন, গল্পটা তাসকিন আহমেদকে নিয়ে।
তাসকিন আহমেদ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এই নামটার আগমন অনেকগুলো স্বপ্নকে সাথে নিয়ে। দীর্ঘদেহী গড়ন, ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করার সামর্থ্য আর দুর্দান্ত অভিষেকের কারণে ক্রিকেট-রোমান্টিকরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন শুরুর দিকের মাশরাফিকে। তবে অভিষেকের কথা যেহেতু বললাম, এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, লাল-সবুজের জার্সিতে তাসকিনের অভিষেক কিন্তু ওয়ানডে দিয়ে নয়, টি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেটিও ২০১৪ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত ঐ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগেই তাসকিন নজর কেড়েছিলেন ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে, ১১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন দেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। পরের বছর অনুষ্ঠিত বিপিএলের সেমিফাইনালে চিটাগং কিংসের হয়ে ৪ উইকেট সংগ্রহ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জার্সিতে তাঁর অভিষেকের সময় সমাগত। বিপিএলের এই পারফরম্যান্সই তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলে, চূড়ান্ত দলে যদিও প্রথমে সুযোগ হয়নি।
কিন্তু টুর্নামেন্টের শেষ দিকে মাশরাফির ইনজুরির পর মূল দলে ডাক পান তাসকিন, অভিষেক হয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। একমাত্র উইকেট হিসেবে ম্যাক্সওয়েলকে আউট করেছিলেন, তবে গতির ঝড়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন অসি ব্যাটসম্যানদের। ওয়ার্নার-ফিঞ্চরা ভাবতেও পারেননি, বাংলাদেশের কোন পেসার নিয়মিত ১৪০ এর উপরে গতি তুলতে পারে!
টি-টোয়েন্টিতে ভালো অভিষেকের পর তাসকিনের অভিষেক হয় ওয়ানডে জার্সিতে। ভারতের বিপক্ষে মিরপুরের ঐ ম্যাচে অসাধারণ বোলিং করেছিলেন তাসকিন, বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করে তুলেছিলেন পাঁচ উইকেট। একেকটা উইকেট পাচ্ছেন, এরপর দু’দিকে দুই হাত মেলে দৌড়াচ্ছেন, যেন উড়ে যেতে চাইছেন নীল আকাশে, তাসকিন আহমেদের শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। দুর্দান্ত বোলিংয়ে ভারতও অলআউট ১০৮ রানে। বাংলাদেশ অবশ্য সেই রান তাড়া করে জিততে পারেনি, মাত্র ৫৮ রানে গুটিয়ে লজ্জার পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। স্টুয়ার্ট বিনির ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ের সামনে তাসকিনের অসাধারণ বোলিংও যেন ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছিল।
তবে বোলার তাসকিনের সেরা সাফল্য দেখা দিয়েছিল ২০১৫ এর বিশ্বকাপে। মাথার ওপর মাশরাফির ছায়া আর সঙ্গী হিসেবে আরেক গতিতারকা রুবেলকে পেয়ে তাসকিন যেন জ্বলে উঠেছিলেন আপন আলোয়। নিয়মিত বিরতিতে দলকে উইকেট উপহার দেওয়ার দায়িত্বটা তুলে নিয়েছিলেন নিজ কাঁধে, পুরো বিশ্বকাপে ৯ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন দলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। শুধু উইকেট সংগ্রহে নয়, তাসকিন নজর কেড়েছিলেন আরো একটা বিষয় দিয়ে। মাশরাফির সাথে সেই বিখ্যাত ‘চেস্ট-বাম্প’ দিয়ে, ‘ম্যাশকিন’ উদযাপন করে!
তাসকিনের এই পারফরম্যান্সের কারণে অধিনায়ক মাশরাফি সাহস পেয়েছিলেন ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে চার পেসার খেলানোর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে। মাশরাফি-তাসকিন-রুবেলের সাথে অভিষিক্ত মোস্তাফিজ, স্বীকৃত স্পিনার বলতে সাকিব একা, তাও আবার ঘরের মাঠে, ভাবা যায়!
তবে প্রথম দুই ম্যাচেই ১১ উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ সব আলো নিজের দিকে নিয়ে নিলেও পার্শ্বনায়ক হিসেবে তাসকিনের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। প্রথম ম্যাচে তো ধাওয়ান-কোহলিকে আউট করে মোস্তাফিজের জন্য কাজটা তিনিই সহজ করে দিয়েছিলেন। তবে এই পার্শ্বনায়ক হওয়াটা শুধুমাত্র ঐ সিরিজের জন্যই নয়, তাসকিনের ক্যারিয়ারের জন্যও। মাশরাফি যাঁকে ‘নায়ক’ বলে ডাকতেন, সেই তাসকিন ধীরে ধীরে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যেতে থাকলেন। ভারত সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে ইনজুরিতে পড়লেন, মিস করলেন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজও। পরের বছর এশিয়া কাপে মোটামুটি ভালো বোলিং করে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিলেও ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে যায় এরপরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ!
এক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যে তাসকিনের আগমন, আরেক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই সেই তাসকিন পড়লেন আইসিসির খাঁড়ায়। ফলস্বরূপ বিশ্বকাপের মাঝপথেই দেশে ফিরতে হলো তাসকিনকে, নিজে আবেগাপ্লুত হলেন, আপ্লুত করলেন অধিনায়ককেও।
বোলিং অ্যাকশন শুধরে ফিরতে সময় নেননি তাসকিন, ফিরেছেন ঐ বছরেই আফগানিস্তান সিরিজ দিয়ে, এরপর খেলেছেন ইংল্যান্ড সিরিজেও। কখনো জ্বলছেন, কখনো নিভছেন, এমন পরিস্থিতিতে টেস্ট অভিষেকও হয়ে গেলো পরের বছরে নিউজিল্যান্ড সফরে, অবশ্যই সেটা কোন সুখস্মৃতি ছিল না। তবে ‘অন অ্যান্ড অফ’ পারফম্যান্স দিয়েও তাসকিন দল থেকে একেবারে বাদ পড়েননি তখনো।
তাসকিনের খারাপ সময় শুরু হয় ২০১৮ সালে, খারাপ বলতে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া আর কী! নিদাহাস ট্রফির প্রথম দুই ম্যাচ খেলে বাদ পড়লেন, এরপর আর ফিরতেই পারছিলেন না জাতীয় দলে। মূলত মাশরাফি-মোস্তাফিজ ‘অটো চয়েস’ আর সাথে কখনো সাইফউদ্দিন, কখনো রুবেল তৃতীয় পেসার হিসেবে দলে সুযোগ পাওয়ায় তাসকিনের সুযোগ ছিল না। তবে তাসকিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, বিশেষত ‘১৮ এর শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বিপিএলে চমৎকার বোলিং করেছিলেন, সুযোগও এসেছিল নিউজিল্যান্ড সফরের দলে। কিন্তু বিধি বাম! নিজের দলের শেষ ম্যাচে ফিল্ডিং করতে গিয়ে আবার ইনজুরিতে পড়লেন তাসকিন, বাদ পড়লেন নিউজিল্যান্ড সিরিজের দল থেকে।
তাসকিনের জন্য সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিটা বোধ হয় এরপরই তৈরি হয়, বিশ্বকাপগামী দলে সুযোগ না পাওয়া। ইনজুরির পর পুরোপুরি ফিটনেস অর্জন করতে না পারায় ইংল্যান্ডগামী বিমানে জায়গা হয়নি তাসকিনের, দল ঘোষণার দিনে তাসকিনের কান্নার সাথে তাই কেবল ’১১ এর বিশ্বকাপ দলে মাশরাফির সুযোগ না পাওয়াকেই মেলানো যায়। তবে শেষ পর্যন্ত ‘বিশেষ বিবেচনায়’ তাসকিনকে দলে রাখার গুঞ্জন শোনা গেলেও বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী ত্রিদেশীয় সিরিজে আবু জায়েদ রাহীর পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি তাসকিনের ফেরার সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দেয়।
তবে তাসকিন আবার ফিরেছেন। বাংলাদেশ দলের করোনা-পরবর্তী প্রথম সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই ফিরেছেন। তবে এবারের ফেরাটা একটু বিশেষ, মাথার ওপরে এখন আর ‘মাশরাফি’ নামক ছায়াটা নেই। কিন্তু তাসকিন চাইলে বলতেই পারেন, ‘মাথার ওপর বটগাছের ছায়া থাকলে, চারাগাছরা কি বড় হতে পারে?’ অবশ্য জাতীয় দলে সাত বছর কাটানোর পর কাউকে ‘চারাগাছ’ বলার সুযোগ আছে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়!
তবে তাসকিনের ফেরাটা আসলেই বিশেষ, সেই পুরনো তাসকিন, গতির ঝড় তোলা তাসকিনকে যেন একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছি আমরা। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতির বোলিংয়ের সাথে ছোট ছোট সুইং যোগ করার মাধ্যমে তাসকিন উন্নতি করেছেন। এবারের নিউজিল্যান্ড সফরেই যেমন, গতি আর সুইং দিয়ে অনেকগুলো সুযোগ তিনি তৈরি করেছেন, ফিল্ডারদের বদান্যতায় বারবার বেঁচে গেছেন ব্যাটসম্যানরা। তবে বোলিংয়ের সময়ে মাথার ব্যবহারে এখনো যেন একটু পিছিয়ে তাসকিন, সঠিক সময়ে স্লোয়ার বা ইয়র্কার দিতে এখনো ঠিক দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি তিনি। ফলস্বরূপ বোলিংয়ের পর ইকোনমি রেটটা একটু বেশিই থাকে তাসকিনের। তবে এই ক্ষেত্রে একটু মগজের ব্যবহারই তাঁকে বাংলাদেশের অন্য বোলারদের থেকে অনেক এগিয়ে নেবে। অন্তত মানসিক ও স্নায়বিকভাবে সেজন্য তাঁকে পরিশ্রমীই মনে হয়, তাছাড়া একবার দলের বাইরে গিয়েও আবার ফিরে আসা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহজ নয়, তাসকিন যা করে দেখিয়েছেন।
একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করি। আগেই বলেছি, জাতীয় দলের তাসকিনের প্রথম আগমন ’১৪ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলে সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। একদিন অনুশীলনের পর ক্লান্ত তাসকিন ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলেন এবং একটা আসন খালি পেয়ে তাতে বসে পড়লেন। পাশ থেকে সাকিব আল হাসান তখন বললেন, ‘তুই যে না বলে বসে পড়লি, জানিস, এটা কার সিট?’ তাসকিন একটু অবাক হলেন, ‘কার?’ ‘মাশরাফি ভাইয়ের’, সাকিব উত্তর দিলেন। সাথে সাথে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন তাসকিন, এক লাফে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সাকিব তখন তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন, ‘ন্যাশনাল টিমেও মাশরাফি ভাইয়ের জায়গাটা তোকেই নিতে হবে’।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মাশরাফি যেমনটা ছিলেন গতি, সুইং আর লাইন-লেন্থে ‘আনপ্লেয়েবল’, তাসকিন কি পারবেন সেই মাশরাফিকে ফিরিয়ে আনতে? গতি আর সুইংটা তো তূণে আছেই, মস্তিষ্কটাকে আরেকটু সচেতন করতে পারবেন না, তাসকিন?
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
শুভ জন্মদিন, তাসকিন আহমেদ!
Discussion about this post